পরিবারের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে প্রবীণেরা সর্বদা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য অনুপ্রেরণা ও নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করে। তাঁদের উপস্থিতি বাড়িতে আনন্দ, শান্তি ও নিরাপত্তার অনুভূতি এনে দেয়। বাংলাদেশের প্রবীণেরা সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাঁদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, স্নেহ পরিবার ও সমাজের জন্য অপরিহার্য। প্রবীণেরা সব সময় সম্মানের, স্মরণীয় ও বরণীয়।
তবে শহুরে ও গ্রামীণ পরিবেশে বসবাসকারী প্রবীণদের জীবনযাত্রা ও অভিজ্ঞতায় বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন গ্রামীণ পরিবারগুলোয় প্রবীণেরা পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে বসবাস করেন। তাঁরা তাঁদের নাতি-নাতনিদের দেখাশোনা করেন, ঘরের কাজকর্মে সাহায্য করেন এবং পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নেন।
এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাঁদের জীবনে আনন্দ ও স্থিতিশীলতা এনে দেয়। অন্যদিকে শহুরে পরিবারগুলোয় প্রবীণেরা প্রায়ই তাঁদের সন্তানদের থেকে আলাদাভাবে বসবাস করেন। ব্যস্ত জীবনযাত্রা ও কাজের চাপের কারণে তাঁদের পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ও দেখাশোনা করার সময় থাকে না। এ কারণে তাঁদের মনে একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি দেখা দিতে পারে।
একইভাবে গ্রামীণ পরিবেশে প্রবীণেরা স্থানীয় সমাজের বিভিন্ন কার্যকলাপে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তাঁরা সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন, তরুণদের পরামর্শ দেন এবং গ্রামের উন্নয়নে অবদান রাখেন। কিন্তু শহুরে পরিবেশে প্রবীণদের সামাজিক অংশগ্রহণের সুযোগ তুলনামূলক কম থাকে। ব্যস্ত জীবনযাত্রা ও পরিবহনব্যবস্থার জটিলতার কারণে তাঁদের সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
নিজের ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। এক সন্ধ্যায় গ্রামে বেড়াতে গিয়ে দেখি প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই প্রবীণ ও নবীনদের এক অনন্য সম্পর্ক। নবীন–প্রবীণ সবাই মিলে গল্প করছেন বাড়ির উঠানের জবাগাছটির তলায়, তাঁদের মুখের হাসি দেখে মনে হচ্ছে গাছের রক্তজবাগুলোও হাসছে, সে এক অপরূপ দৃশ্য!
কোথাও দেখা যায়, পরিবারের লোকজনের সঙ্গে বসে তাঁরা তাঁদের জীবনের গল্পকথা ও বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করছেন, অন্যরা মুগ্ধ হয়ে শুনছেন তাঁদের কথা। আবার কিছু বৃদ্ধ মাথায় টুপি, লুঙ্গি–পাঞ্জাবি পরে ছুটে চলেছেন মসজিদের দিকে। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয়, এই বৃদ্ধ বাবা–মায়েরা তাঁদের সন্তানদের কাছে কোনোরূপ বোঝা মনে হচ্ছে না।
অথচ আজ বৃদ্ধাশ্রমে গেলে দেখা যায়, নামীদামি চাকরি করা সন্তানদের অনেক মা–বাবা পড়ে আছেন সেই বৃদ্ধাশ্রমে, তাঁদের দিন কাটছে চোখের জলে, করছেন মৃত্যুর অপেক্ষা। তাই সন্তানদের নামকরা স্কুল–কলেজেই পাঠালে হবে না; মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবিকতা বোধ আর সম্মান করার শিক্ষাও দিতে হবে।
সরকারি চাকরিজীবী করতে না পারলে আফসোস না করে প্রকৃত মানুষ হওয়ার শিক্ষাটা অন্তত দিন। দরকার হয় কায়িক শ্রম শিখিয়ে সহজ–সরল জীবনের পথে সম্মানের শিক্ষা দিয়ে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করুন, যাতে বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যু পর্যন্ত সন্তানদের কাছে একটু ঠাঁই পাওয়া যায়।
প্রত্যেক সন্তানের উচিত নিজের বাড়ির সৌন্দর্য ধরে রাখা, বৃদ্ধ বয়সের মা–বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁদের সফলতার হাসি দেখা। এটা সেই সফলতা, যা তাঁর সন্তানদের সত্যিকারের ভালো মানুষ করে গড়ে তোলার সফলতা।
মোসা. হালিমা খাতুন
শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়