ঢাকা-শরীয়তপুর মহাসড়কের ‘ক্ষত’ শুকাতে আর কত দিন?

ঢাকা–শরীয়তপুর সড়ক

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প পদ্মা সেতুর কাজ যখন প্রায় শেষ দিকে, তখনই পদ্মা সেতুর দক্ষিণ মাথার জেলা শরীয়তপুরের সঙ্গে পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক চার লেনে উন্নীত করার জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক নির্বাহী কমিটি (একনেক) ২০২০ সালে ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দিলেও শরীয়তপুর জেলার সড়ক ও জনপথ বিভাগ, জেলা প্রশাসনের অবহেলা এবং জনপ্রতিনিধিদের উদাসীনতার কারণে ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন; সেই প্রকল্পের মেয়াদ গত জুন মাসে শেষ হলেও উক্ত প্রকল্পের আওতায় সড়ক নির্মাণসহ ২টি আরসিসি সেতু, ছোট-বড় ২৭টি কালভার্ট নির্মাণকাজ বাস্তবায়িত হয়নি।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর যখন শরীয়তপুর জেলায় গণপরিবহনসহ পণ্যবাহী ও অন্যান্য যানবাহনের চাপ বাড়তে থাকল এবং সড়ক সরু হওয়ায় সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়া এবং যানজটের মতো দুর্ভোগে পড়ে জেলার মানুষ ফুঁসে উঠল, তখন জেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, সওজসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসল এবং জনগণকে জানাল, জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে।

তবে এই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হতে এবং পদ্মা সেতুর সুফল পেতে শরীয়তপুরের জনগণকে আরও ২ বছর; অর্থাৎ ২০২৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। শরীয়তপুরবাসী জেলার নীতিনির্ধারকদের দায়িত্বহীনতা, অবহেলা ও ভুলের মাশুল দিতে ২ বছর অপেক্ষার বিষয়টিও নীরবে মেনে নিল।

এখন কথা হচ্ছে, এই মেনে নেওয়া কি শরীয়তপুরবাসীর চরম অপরাধ হলো? নয়তো কেন প্রকল্পের আওতাধীন কাজের বাস্তবায়নে দুই বছর সময় নেওয়ার পরও দায়সারাভাবে প্রকল্পের কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে? কেন জুনের পর থেকে গত ৫ মাসে মাত্র ২৫ শতাংশ কাজও ঠিকমতো সম্পন্ন করা হলো না?

৬ মাস হতে চললেও এখন পর্যন্ত শরীয়তপুর সদর থেকে পদ্মা সেতু পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার সড়কের জন্য জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করতে পারেনি জেলা প্রশাসন। এই সড়কে দুটি সেতু চরম ঝুঁকিপূর্ণ, তাই তা সওজ কর্তৃক ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করার পরও তা দিয়ে প্রতিনিয়ত শত শত মানুষের জীবন অনিশ্চয়তায় রেখে যাত্রীবাহী ভারী যানবাহন চলাচল করছে। এসব যানবাহন চলাচলের বিকল্প ব্যবস্থা করার সুযোগ থাকলেও তা কর্ণপাত করা হচ্ছে না।

এই প্রকল্পের সর্বক্ষেত্রে কাজের গতি দেখে বোঝা যাচ্ছে, কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত দুই বছর শেষ হওয়ার পরও অধিকাংশ কাজ বাকি থেকে যাবে এবং তারা কাজ সম্পন্নের জন্য আরও সময় বাড়িয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করবে।

আর সবচেয়ে বড় বিষয়ে হচ্ছে, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর অতিরিক্ত যানবাহন চলাচলের কারণে পদ্মা সেতু থেকে শরীয়তপুর জেলা সদর পর্যন্ত এই ২৭ কিলোমিটার সরু রাস্তার অধিকাংশ স্থানে বড় বড় গর্ত (যা আমি ক্ষত হিসেবে উল্লেখ করেছি) তৈরি হয়েছে। যার কারণে পদ্মা সেতু উদ্বোধন থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটেছে।

এ ছাড়া জাজিরা উপজেলা থেকে জেলা সদরে চলাচলকারীরা এই সড়কে এক দিন চললে ধুলাবালু আর রাস্তা ভাঙাচোরার কারণে ঝাঁকুনিতে চরমভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। আর কোনো রোগী হলে তো বলার কিছু থাকে না। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বাদের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ একটি অবস্থা তৈরি হয়েছে।

এই সড়কে প্রয়োজনে নিয়মিত চলাচলকারী কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম, তাঁদের ভাষ্য ছিল এমনটি, ‘এই রাস্তার কাজে যাঁরা দায়িত্বে আছে, তাঁদের বিচার হওয়া উচিত। এলাকার সব নেতার (জনপ্রতিনিধি) নাকে খত দিয়ে জনগণের কাছে মাফ চেয়ে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়া উচিত। তাঁদের গাফিলতির কারণে পদ্মা সেতু হওয়ার পরও আমরা প্রতিনিয়ত কষ্টে আছি, আমাদের আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের লোকদের দুর্ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে। আমাদের সবার জীবন কচুপাতার ওপর এক ফোঁটা পানির মতো আছে।’

গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, সড়কের এই বেহালের কারণে গত ৫ মাসে এ সড়কে শতাধিক ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছেন অন্তত আটজন। আনোয়ার হোসেন জাজিরা থেকে জেলা সদরে যাচ্ছিলেন। রাস্তা প্রসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘আমাদের এমপি-মন্ত্রী আর সরকারি অফিসাররা তো দামি গাড়িতে গ্লাস বন্ধ করে দোল খেতে খেতে চলে যান। তাঁরা বুঝবেন কীভাবে তাঁদের ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দোল খাওয়া আমাদের সাধারণ মানুষের নাক-মুখ বন্ধ করে হাড্ডি-মাংস এক হওয়া।’

এদিকে গণমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তরে সওজের পক্ষ থেকে সেই পুরোনো রেকর্ড বাজানো হচ্ছে। সওজের বক্তব্য, ‘গত মেয়াদের মধ্যে কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি করোনা মহামারির কারণে, এখন জেলা প্রশাসন জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করে আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে না। তাই কাজে কিছুটা ধীরগতি রয়েছে।’

আমার কথা হচ্ছে, যেহেতু এই রাস্তার কাজ সম্পন্ন করতে এত সমস্যা, তাহলে আধা কাজ ধরে এভাবে ফেলে রাখলেন কেন? বুঝলাম, কাজ এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাহলে অন্তত জনগণের স্বস্তিতে চলাফেরার জন্য সাবেক সড়কটি সংস্কার করে দিচ্ছেন না কেন? নাকি এই বেহাল রাস্তায় শরীয়তপুরবাসীর দুর্ভোগ পোহানো দেখে আপনারা ‘পৈশাচিক’ আনন্দ পাচ্ছেন!

জেলা প্রশাসন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রতি অনুরোধ, চার লেন সড়কের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে সদিচ্ছা নিয়ে কাজ করার এবং দায়সারা ভাব না নিয়ে কাজ শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত কিছুটা স্বস্তিতে চলাচলের জন্য সাবেক রাস্তাটি প্রয়োজনীয় সংস্কার করার, নয়তো বিকল্প সড়কের ব্যবস্থা যেন করে। জনপ্রতিনিধিদের প্রতি অনুরোধ, জনগণ আপনাদের প্রতিনিধি করেছেন তাঁদের সমস্যা সমাধানে কাজ করার জন্য, তাঁদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করার জন্য।

জনগণের কথা সর্বোচ্চভাবে মাথায় রেখে নিজেদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করুন। নয়তো জনতা বারবার আপনাদের এই গাফিলতি মেনে নেবেন না। জনরোষ তৈরি হলে আঁস্তাকুড়েও জায়গা পাবেন না।

মো. পলাশ খান
সমাজকর্মী ও সাংবাদিক