ঋণের চাপে আত্মহত্যা: সন্তানদের স্বপ্ন পূরণ করবে কে?

জয়পুরহাট আক্কেলপুরের রানী। সে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। তার মা-বাবা খুব আদর করে নাম রেখেছেন রানী। বাবা-মায়ের অনেক বড় স্বপ্ন, তাঁদের মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। এমন প্রত্যাশার কথাই সবার কাছে প্রায় বলে থাকেন। রানীর বাবা মাসুদ রানা অটো ভ্যানচালক। ভ্যানের চাকা ঘুরলে তাঁর সংসার চলে। রানীর মায়ের নাম হীরামণি। তিনি গৃহিণী। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে অবস্থান করেন। তবে জানা যায়, তিনি সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ফলে বাড়িতে থাকেন সব সময়।

তাঁদের নিজস্ব কোনো জমি নেই। একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ভিটেমাটির জায়গাও কেনেন। সেই জায়গায় একটি মাটির ঘর তৈরি করেন। ছোট সংসার নিয়েও খুব দুশ্চিন্তায় থাকেন মাসুদ রানা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সংসার ও মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হিমশিম খান। বিশেষ করে করোনা মহামারির সময়ে লকডাউনে কাজ না পেয়ে আটটির মতো বেসরকারি সংস্থা থেকে তিন লক্ষাধিক টাকা সাপ্তাহিক, মাসিক এবং এককালীন কিস্তিতে ঋণ নিয়েছিলেন। কিছুদিন তাঁরা ঠিকমতো কিস্তি পরিশোধও করেছেন। হঠাৎ করেই মাস কয়েক থেকে তাঁরা নিয়মিত কিস্তি দিতে পারছিলেন না। কিস্তি দেবেন কী করে?

বাজারে দ্রব্যমূল্য পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলেছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যে হাতের নাগালে নেই, তা কেউ বোঝে না। আর রাষ্ট্রযন্ত্র বোঝার চেষ্টা করে না। যা-ই হোক, মাসুদ রানা একটি এনজিও থেকে ৩৫ হাজার টাকা ছয় মাস মেয়াদি ঋণ নিয়েছিলেন। এক সপ্তাহ আগে ঋণের টাকার সুদ-আসলে ৩৯ হাজার টাকা পরিশোধ করার কথা ছিল। কিন্তু টাকা দিতে পারেননি। টাকা দিতে পারেননি বলে তো এনজিওর কর্তা চুপ করে বসে থাকতে পারেন না। পুঁজিবাদের ধর্ম তো পুঁজির পাহাড় গড়ে তোলা। চরম মূল্য দিয়ে হলেও শ্রমিকশ্রেণির কাছ থেকে টাকা আদায় করাই তো লক্ষ্য তাঁদের।

শনিবার সরকারি ছুটির দিন। সেই ছুটির দিনেও বকেয়া ঋণের টাকা আদায় করতে এনজিওর মাঠকর্মীরা বাড়িতে হাজির। তাঁরা বাড়িতে এসে দেখেন, বাড়ির মালিক মাসুদ রানা বাড়িতে নেই। তাঁকে না পেয়ে স্ত্রী হীরামণিকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এনজিওর কর্মীরা। হীরামণি কখনো এমন পরিস্থিতির মুখে পড়েননি। অপমান সহ্য করতে না পেয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন।

হীরামণি কি একাই পৃথিবীতে থেকে চলে গেলেন? সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন তাঁর পেটের সন্তানকে। একজন গর্ভধারিণী মা সন্তানসহ পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন আর রেখে গেলেন তাঁর আদরের রানীকে। একসময় তাঁর মেয়েকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেটি কি বাস্তবায়িত হবে? তাঁর মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলব নাকি হত্যা বলব? তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? হত্যাকারীদের বিচার হবে নাকি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিয়ে দায় শেষ হবে? এ রকম ঋণের চাপে আরও কত হীরামণিকে জীবন দিতে হয়েছে, তার নেই শেষ। এর কি কোনো সমাধান নেই?

রাষ্ট্রের কাছে জনগণ কী চায়? আত্মহত্যা করার জন্য কেউ তো পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে না। তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন, যে দেশের জনগণ অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়ে জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের পথ বেছে নেয়, সেই দেশের মানুষ কি শান্তিতে আছে? উত্তরটা খুঁজে পাব ওই হীরামণির কাছে। খোঁজ করলে দেখা যাবে, আমাদের দেশে এক হীরামণি শুধু এমনভাবে জীবন দেননি। পরিসংখ্যানের পরিস্থিতি বোঝা যায় ঠিক তখন, যখন পত্রিকার পাতা খুললে আত্মহত্যার খবর চোখে পড়ে।

স্বাধীনতার ৫১ বছরের বাংলাদেশের চিত্র হচ্ছে, দিন দিন বেড়েই চলেছে দিনমজুর হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা। পথেঘাটে, মাঠে-ময়দানে, রেলওয়ে স্টেশন, বিমানবন্দরে—যেখানে মানুষের চলাচল, সেখানে হাত পেতে বসে থাকে জরাজীর্ণ দেহ নিয়ে কয়েকটা টাকার জন্য। আত্মহত্যা না করলেও জীবিত থেকেও যেন তারা মৃত। একেকজন হীরামণি যেন। এর জন্যই কি এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল?

রাশেদুজ্জামান রাশেদ

সংবাদকর্মী

[email protected]