১৯৭১ সাল ১৬ ডিসেম্বর, এই সাল ও তারিখের তাৎপর্য জানতে হলে আমাদের ফিরে দেখতে হবে পূর্ব পাকিস্তানের উৎপত্তি কোথা থেকে। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশন হয়। এ অধিবেশনে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক।
এ প্রস্তাবের মূলকথা ছিল পুরো ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী হওয়ায় এ দুটি অঞ্চল আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে এবং ভারত নামে আরেকটি সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হবে। তবে তা না হয়ে শুধু দুটি দেশ গঠিত হয়। ভারত ও পাকিস্তান। আর এই পাকিস্তান দেশ একটি তবে দুটি ভাগে বিভক্ত, একটি হলো পূর্ব পাকিস্তান এবং অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তান।
পশ্চিম পাকিস্তান তখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর নানভাবে অত্যাচার ও শাসন-শোষণ শুরু করে। ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি কর্মক্ষেত্র, প্রশাসনিক সব স্তরে পশ্চিম পাকিস্তান বৈষম্য তৈরি করে। সব ক্ষেত্রে প্রায় ৯০ শতাংশ পাকিস্তানি লোক কাজ করতেন। বাঙালিদের সঙ্গে সব স্তরে বৈষম্য ও অত্যাচার–নিপীড়ন করে তারা।
১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় ঘোষণা করেন যে উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এতে বাঙালিরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৫১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন তীব্র হয় এবং এদিন বাংলা মায়ের কয়েকজন দামাল সন্তান শহীদ হন। তবে আন্দোলন থেমে থাকেনি। অবশেষে আন্দোলনে টিকতে না পেরে ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। তারপর ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন চালু করেন। আর এই শাসন চলে টানা ১১ বছর। সামরিক শাসন কখনো একটি দেশের জন্য সুখকর নয়। এ সামরিক শাসন ও বাঙালির ওপর অত্যাচার-নির্যাতন কখনো মেনে নিতে পারেননি পূর্ব বাংলার কেউ।
পরবর্তী সময়ে ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবি ঘোষণা করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ ঘোষণার ফলে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে জেলে বন্দী করে পাকিস্তানি সরকার এবং বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে দেশদ্রোহিতার মামলায় প্রধান আসামি করা হয়। বাঙালিরা এটি মানতে পারেননি।।আবার শুরু হয় আন্দোলন–সংগ্রাম। এ আন্দোলন একপর্যায়ে গণবিস্ফোরণে রূপ নিল। ১৯৬৯ সালে গণ–আন্দোলনে সব স্তরের বাঙালি অংশগ্রহণ করেন এবং শহীদ হন অনেকে। সেদিন শহীদ হয়েছিলেন কিশোর মতিউর। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয় বঙ্গবন্ধুসহ সব নেতাকে মুক্তি দিতে।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানে প্রথম জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে পূর্ব পাকিস্তান জয়লাভ করে। তবে পশ্চিম পাকিস্তান কোনোভাবেই রাজি ছিল না পূর্ব পাকিস্তান সরকার পরিচালনা করবে। তারা শুরু করে ষড়যন্ত্র, কী করে ক্ষমতা হস্তান্তর করা না যায়, এই নীলনকশা তৈরি করতে থাকে এবং ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেন। এ ঘোষণা রেডিওতে প্রচার হওয়ার পর বাঙালিরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাঁদের মুখে উচ্চারিত হয় স্বাধীনতার স্লোগান—‘জয় বাংলা’,‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’
শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলা হয়। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় জাতীয় সংগীত হিসেবে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি নির্বাচন করা হয়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দেন। লাখ লাখ মানুষ যোগ দেন তাঁর ভাষণ শুনতে। এ ঐতিহাসিক ভাষণ সারা দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল এবং স্বাধীনতার সংগ্রামের জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল।
২৫ মার্চ রাতে পশ্চিম পাকিস্তানিরা অপারেশন সার্চলাইট নামে গণহত্যার পরিকল্পনা করে। যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করা। এ উদ্দেশ্য তারা বাস্তবায়ন করে এবং তাদের উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা। সেই রাতে নিষ্ঠুরতম গণহত্যা সংঘটিত হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক কমান্ডো দল এসে রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের আগে তিনি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন।
২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়। ফলে ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে বিবেচিত হয়। ২৫ মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের কেউ নিরাপদ ছিলেন না। তাই প্রায় এক কোটি বাঙালি শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের সময় কারাগারে থাকায় তাজউদ্দীনের আহবানে গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার দেশি–বিদেশি সাংবাদিকদের সামনে শপথ গ্রহণ করে। এর মধ্য দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। চলতে থাকে যুদ্ধ। ৩০ লাখ বাঙালি শহীদ হন। অসংখ্য নারী ধর্ষণের শিকার হন। টানা ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর এল বাংলার বিজয়। ১৯৭১ সালের এদিন পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
এ দেশ আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। যাঁরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে এ দেশকে স্বাধীন করেছেন, তাঁদের আমরা গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি। প্রত্যেক বাঙালির হৃদয়ে রয়েছে সব স্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আজ গর্ব করে বলতে পারি, আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের দেশ নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা আমাদের পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এ দেশ একদিন সোনার বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে, এটি আমাদের কামনা।
সৈয়দ সাজিদ হোসেন
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ