কারিগরি শিক্ষাকে কেন ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে

১২ আগস্ট শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সকে তিন বছরে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী যে যুক্তি দিয়েছেন, তা অযৌক্তিক এবং একেবারে অগ্রহণযোগ্য। ব্রিটিশ ভারত ভেঙে দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির পর তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট (বর্তমান ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট) গঠিত হয় এবং এই ইনস্টিটিউটে তিন বছরের ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স চালু হয়। একই সঙ্গে বর্তমান বুয়েটে (তৎকালীন আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ) ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স চালু ছিল। দীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা নিজেদের সামাজিক অবস্থান, মেধা ও যোগ্যতা অটুট রেখেছে। সেইসঙ্গে দেশের উন্নতিতে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।

কিন্তু স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা অবহেলিত ও বঞ্চিত এবং কালেভদ্রে ‘ষড়যন্ত্রের’ শিকার। সময়ে–সময়ে ডিপ্লোমা কোর্সকে ইংরেজি মাধ্যম থেকে বাংলা মাধ্যমে রূপান্তরিত করা, বিভিন্ন অজুহাতে ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি পরীক্ষা বাতিল, উচ্চশিক্ষার সুযোগ সীমিত রাখার খোঁড়া যুক্তিসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ডিপ্লোমা কোর্সের মান নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। এ ধরনের তৎপরতার হীন উদ্দেশ্য ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করা। কিন্তু এ দেশের সরকারি–বেসরকারি চাকরিতে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা নিজেদের যোগ্যতা এখনো অটুট রেখেছেন। কারিগরি শিক্ষার প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই আন্তরিক। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সকে তিন বছর থেকে চার বছরে উন্নীত করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী কারিগরি শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তর ডিপ্লোমা কোর্সকে তিন বছরে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়ে আমাদের অস্তিত্বসংকটের পথ তৈরি করতে যাচ্ছেন।

শিক্ষামন্ত্রী কারিগরি শিক্ষার বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করে বরং সরকারের প্রতি পলিটেকনিক শিক্ষক-ছাত্র-পেশাজীবীদের ক্ষোভ বাড়িয়ে দিলেন। পলিটেকনিক ক্যাম্পাসে নোট ও গাইডের ছড়াছড়ি। শিক্ষামন্ত্রী সেটা বন্ধে কী উদ্যোগ নিয়েছেন? শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর তিনি যে যুক্তিতে পলিটেকনিকে ভর্তির ক্ষেত্রে বয়সের বাধা তুলে দিয়েছেন, সেই যুক্তি কি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োগ করতে পেরেছেন? কারিগরি শিক্ষা বলতে কেন এ দেশের জনগণকে জোর করে ডিপ্লোমা কোর্সকেই বোঝানো হয়, সেটার কি সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন? কারিগরি শিক্ষা মানে তো বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রিও, ভকেশনাল (এসএসসি ও এইচএসসি) সার্টিফিকেটও এবং শর্ট কোর্সও; এই সত্য কেন বারবার লুকিয়ে রাখা হয়, সেটার কি ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন?
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও ডিপ্লোমা কোর্সের জন্য কেন পাঠ্যপুস্তক নেই এবং কী কারণে শিক্ষার মাধ্যম বা মিডিয়াম ইংরেজি থেকে বাংলায় পরিবর্তন করা হয়েছে, তার কোনো ব্যাখ্যা কেন তিনি দেন না? বুয়েটের কিংবা মেডিকেলের ছাত্র যদি বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করতে পারে, তাহলে পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা কেন সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত? ১৯৮৮ সালের শিক্ষা কমিশন বুয়েটের শিক্ষকদের বাংলা ভাষায় ইঞ্জিনিয়ারিং ও কারিগরি বই প্রণয়ন করার অনুরোধ করেছিল। শিক্ষা কমিশনের সেই অনুরোধ কি বুয়েট বা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আজ পর্যন্ত রেখেছিল বা রাখার চেষ্টাও করেছিল? পলিটেকনিক ক্যাম্পাসে নকল কেন বন্ধ হলো না?

এসব প্রশ্নের উত্তরে কী বলবেন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি এত সব সমস্যা সমাধানে কিছুই করেননি, চেষ্টাও করেননি। অথচ খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সকে একপ্রকার ধ্বংসের পথে ঠেলে দিলেন। যারা ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের অস্তিত্ব বিলীন করার প্রচেষ্টায় নেমেছে, তাদেরকে উৎসাহিত করলেন। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক এবং কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থার জন্য আত্মঘাতী। আশা করি, সরকার ও শিক্ষামন্ত্রী তাঁর অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবেন এবং কারিগরি শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে বাস্তবসম্মত, যৌক্তিক ও টেকসই পদক্ষেপ নেবেন।

মো. সাইফুল ইসলাম
সদস্য, আইডিইবি
বায়েজিদ, চট্টগ্রাম।