বাসার গলি ধরে চলাচলে, বিশেষ করে রাতের নীরবতায়, একটা শব্দ বেশ অস্বস্তিতেই ফেলছে ইদানীং। শব্দটা হলো গ্যাস লিক করার শব্দ; জোরেশোরেই হচ্ছে, খেয়াল রাখলে ২-৩ মিটার দূর থেকেই শোনা যায়। আমাদের ময়মনসিংহ সদরের কেওয়াটখালি এলাকার তিতাসের যে আবাসিক লাইনগুলো আছে সেগুলো নন-মিটার, তাই এই সব লিক নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই বললেই চলে। তাছাড়া, প্রাকৃতিক গ্যাসের মিথেন বায়ু থেকে হালকা আর লিকগুলো খোলা জায়গায় হওয়ায় অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাবনাও কম। তবে বিষয়টিতে আরও ভাবনার বিষয় আছে।

লিকগুলো হয় গ্যাস লাইনের, যেখানে রেগুলেটর যুক্ত করা হয়, সেখানে (সংযোগ পয়েন্ট)। সম্ভবত, প্রত্যেক বাড়িতেই সংযোগ স্থাপনের সময় রেগুলেটরের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করা হয়, আর এমনিতে গ্যাসের পাইপ মাটির নিচ দিয়ে গেলেও রেগুলেটর সংযোগের স্থানটি মাটি থেকে উপরে হয়। অনেকটা উল্টো ইউয়ের মতো, যার শীর্ষে ধূসর রঙের ছোট পাতিল আকৃতির রেগুলেটর থাকে। জায়গাটিতে একাধিক অ্যাঙ্গেল, রেগুলেটরের উপস্থিতিতে কয়েকটি জয়েন্ট থাকে, যার থেকেই ফাঁকফোকর দিয়ে গ্যাস বেরিয়ে যায়। আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, অধিকাংশ সংযোগ পয়েন্ট থেকেই অল্প হলেও লিক হয় এবং বড় আকারের লিক পাওয়া মোটেই দুষ্প্রাপ্য নয়। দেশব্যাপী সরবরাহকৃত সকল অঞ্চলেই একই রকম চিত্র পাওয়া যাবে বলে আমার ধারণা। মরিচা পড়া, শীত-গ্রীষ্মে তাপমাত্রা পরিবর্তনজনিত সংকোচন-প্রসারণ, বড় গাড়ি দ্বারা সৃষ্ট কম্পন এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক ক্ষয়ের কারণে সময়ের ব্যবধানে লিক সৃষ্টি ও বৃদ্ধি পায়। এমন লাখ লাখ সংযোগ পয়েন্ট থেকে বছরের পর বছর, দিনে-রাতে অনবরত গ্যাস বেরিয়ে যাচ্ছে, আর গ্যাসের এই অপচয় বন্ধে কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ অপ্রতুল।

কী ক্ষতি হচ্ছে

প্রথমত, আমরা গ্যাস সংকটে রয়েছি। গ্যাস আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল (৬০ শতাংশ বিদ্যুতের কাঁচামাল), সার ও প্লাস্টিকসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পের কাঁচামাল, কলকারখানার জ্বালানি। খাদ্য উৎপাদন, শিল্প উৎপাদন, পণ্য রপ্তানি, লোডশেডিং—সবই গ্যাসের সরবরাহের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একদিকে দেশীয় জ্বালানি অনুসন্ধানে মনোযোগ কম, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে (স্পট মার্কেটে) গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই গ্যাস অপচয় রোধ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দ্বিতীয়ত, এই প্রাকৃতিক গ্যাস সরাসরি বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্ত হতে দিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে আমরা স্বাভাবিকের চেয়ে আরও বেশি ত্বরান্বিত করছি। তেল, কয়লার মতো প্রাকৃতিক গ্যাসও জীবাশ্ম জ্বালানি, যার দহনে কার্বন-ডাই-অক্সাইড সৃষ্টি হয়ে বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্ত হয়, যা গ্রিন হাউস ইফেক্টের জন্য দায়ী। আবার প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রধান উপাদান মিথেন (৯৬ শতাংশ) নিজেও একটি গ্রিন হাউস গ্যাস, বৈশ্বিক উষ্ণায়নে সার্বিক অবদানের দিক থেকে যার অবস্থান দ্বিতীয়। বায়ুমণ্ডলে পরিমাণের দিক থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের তুলনায় মিথেনের পরিমাণ নগণ্য হলেও, ইউএনইপির জুলাই,২০২২ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নে মিথেনের অবদান ২৫ শতাংশের অধিক। কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে মিথেনের উচ্চ তাপ ধারণ ক্ষমতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, স্বাভাবিক হিসাবে মিথেনের তাপ ধারণ ক্ষমতা কার্বন ডাই অক্সাইডের তুলনায় ১০০ গুণেরও বেশি, তবে যেহেতু বায়ুমণ্ডলে অবস্থানকালে মিথেন নিজে থেকেই ধীরে ধীরে বিয়োজিত হয়ে যায়, তাই সময়ের ব্যবধানে এই পার্থক্য কমে আসে; ২০ বছরের ব্যবধানে তা হয় ৮০ গুন, ১০০ বছরের ব্যবধানে হয় ২৫ গুণ। সোজা কথায়, একই পরিমাণ মিথেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড যদি একই সময়ে বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে ২০ বছরে কার্বন ডাই-অক্সাইড যে পরিমাণ উষ্ণায়ন ঘটাবে, মিথেন তার ৮০ গুণ ঘটাবে।

কতটা অপচয় হচ্ছে

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কোন দেশের মিথেন নির্গমন কেমন তা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে। যদিও মিথেনের উৎস যে শুধু লিক হওয়া প্রাকৃতিক গ্যাস তা নয়; কৃষিজমি, ময়লার ভাগাড়, তেল-গ্যাস ক্ষেত্র, এগুলোও অন্যতম উৎস। ২০২১ সালে প্যারিসের একটি কোম্পানি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ঢাকার উপর মিথেনের বিশাল মেঘ শনাক্ত করে বলে জানায়। এই বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখকৃত বাংলাদেশের একজন পরিবেশ বিজ্ঞানীর মন্তব্য অনুসারে, ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাই এর গ্রহণযোগ্য সম্ভাব্য কারণ, যদি আদৌ ওই মিথেনের উৎপত্তি ঢাকায় হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে গ্যাস লাইনের সংযোগ ত্রুটির জন্য গ্যাস অপচয়ের পরিমাণ নিয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষের কোনো গবেষণা বা অনুসন্ধান রয়েছে কিনা, জানা নাই। তবে ইন্টারনেটে অনুসন্ধানে ২০১৫ সাল নাগাদ প্রকাশিত একটি গবেষণা পেপার পেয়েছি (প্রথম লেখক পি সি মণ্ডল, তৃতীয় লেখক এস এম মোরশেদ),  যা বাংলাদেশের ‘ফিউজিটিভ মিথেন ইমিশন’, অর্থাৎ গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থায় কী পরিমাণ গ্যাস অপচয় হয় তা নিয়ে ধারণা দেয়। গবেষণা পত্রটি অনুসারে, তিতাসের মোট বিক্রীত গ্যাসের ২ দশমিক ১ শতাংশ শুধু ভূ-উপরস্থ লিকেজগুলোর কারণে হতো (২০১৫ নাগাদ), এবং এই পরিমাণ পরবর্তী সময়ের রক্ষণাবেক্ষণ পদক্ষেপ ছাড়া, আরও বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। এই অপচয় হওয়া গ্যাসের ৮৭ শতাংশ নির্গত হয় বাসাবাড়িতে সরবরাহ ব্যবস্থা থেকে।

২০২১-২২ সালের তথ্য মতে, তিতাসের বছরে বিক্রীত গ্যাসের পরিমাণ ১৫,৬৫৭ এমএমসিএম (মিলিয়ন কিউবিক মিটার) এবং আবাসিক (বৈধ) ক্রেতার সংখ্যা ২৮ দশমিক ৫৬ লাখ। হিসাবে বাসাবাড়ির সংযোগে বছরে অপচয় আসে প্রায় ২৮৬ এমএমসিএম। একজন গ্রাহকের নন-মিটার সংযোগে বিইআরসি অনুমোদিত মাসিক গড় ব্যবহার ৭৭ ঘনমিটার ধরা হয় (যদিও প্রিপেইড সংযোগের বিল অনুযায়ী এই মান ৪০ ঘনমিটার। এখন গ্যাস অপচয়ের আর্থিক দায় কি ভোক্তাদের নিতে হচ্ছে কিনা, সে ব্যাপারে প্রশ্ন থাকে)। সেই হিসাবে তিতাসের আবাসিক খাতে অপচিত গ্যাসের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ ১০ হাজার গ্রাহকের ব্যবহৃত গ্যাসের পরিমাণের সমান; তারাই মূলত তিতাসের গায়েবি গ্রাহক, শতকরা হিসাবে যাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০০ জনে প্রায় ১১ জন। তবে, ভূগর্ভস্থ লিকেজ, বিগত কয়েক বছরে লিকেজ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা, অবৈধ সরবরাহ লাইন, ক্রেতার পরিমিত মাথাপিছু ব্যবহার, এসব হিসাব বিবেচনায় নিলে গায়েবি সংযোগ সংখ্যার মোট ও শতকরা, দুটোর পরিমাণই বৃদ্ধি পাবে।

অল্প কথায় বললে, তিতাসের গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থায় যে পরিমাণ লিকেজ হয়, তাতে প্রতি ১০০ জন আবাসিক গ্রাহকে ১১টি গায়েবি গ্রাহকের সৃষ্টি হচ্ছে যারা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে গ্যাস ব্যবহার করছে; যাদের ব্যবহৃত গ্যাস দেশের কোনো ধরনের কোনো চাহিদা পূরণ তো করছেই না, বরং সম্পূর্ণ গ্যাসটুকুই বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কাজে ব্যবহার হচ্ছে এবং খুব কার্যকরীভাবেই ব্যবহার হচ্ছে। এই গায়েবি গ্রাহকদের গায়েব করার মোক্ষম সময় হয়তো এখনই, যখন দেশ জ্বালানি সংকটে জর্জরিত, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন নিজে বারবার জনগণকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন, যখন এলাকায় এলাকায় তিতাস কর্তৃপক্ষও অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণে অভিযান চালাচ্ছে; ঘাটতি সম্ভবত শুধু সচেতন দৃষ্টিপাতের ।

খান সাদী মাহমুদ
কেওয়াটখালী, ময়মনসিংহ