নতুন কারিকুলাম: শিক্ষার্থীরা বলে বইয়ে কোনো পড়া নেই, সবই গল্প

নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণির আগের সব পাবলিক পরীক্ষা তুলে দেওয়া হয়েছে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা পদ্ধতিতেও আনা হয়েছে পরিবর্তন। এ ছাড়া থাকছে না নবম শ্রেণিতে বিভাগ পছন্দের সুযোগ। এর বদলে একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা পছন্দমতো বিভাগে পড়তে পারবে। ২০২৩ সালে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণিতে নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ বছর বাস্তবায়ন করা হবে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। এরপর ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে একাদশ শ্রেণিতে এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।

শিক্ষার্থীদের আনন্দময় পরিবেশে পড়ানোর পাশাপাশি মুখস্থনির্ভরতার পরিবর্তে দক্ষতা, সৃজনশীলতা, জ্ঞান ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে শেখাতেই নতুন এই শিক্ষাক্রম চালু করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০টি সাধারণ বিষয় পড়তে হবে। এসএসসি পরীক্ষা হবে দশম শ্রেণির পাঠ্যক্রমের ওপর। আর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে প্রতিবছর দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে। গত বছর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছে। চলতি বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে এবং আগামী বছর চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে চালু হবে এ নিয়ম। এর আলোকে ২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা হবে।

এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান জানান, পরীক্ষার জন্য মার্কিং সিস্টেম থাকবে না। মূল্যায়নকারীরা ফলাফলকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করবে। চতুর্থ শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিবছরের জন্য মিডটার্ম এবং ফাইনাল পরীক্ষা হবে। এসএসসি এবং এইচএসসি শিক্ষার্থীদের শুধু চূড়ান্ত পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে।

নতুন কারিকুলামের বই পেয়ে শিক্ষার্থীদের কী অনুভূতি, তারা কতটুকু গ্রহণ করতে পেরেছে পরিবর্তনকে? তারা কি নতুনকে সহজবোধ্য মনে করছে, নাকি কঠিন আর অহেতুক ভেবে বই থেকে দূরে সরছে? নতুন মূল্যায়নপদ্ধতি তাদেরকে কতটুকু উৎসাহ প্রদান করছে নিজেদের মেধা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে? শিক্ষকেরা কতটুকু শেখাতে পারছে নতুন পাঠ্যসূচি? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে যেতে হবে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের কাছে।

অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের নতুন কারিকুলাম নিয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তারা উত্তরে বলে বইয়ে কোনো পড়া নেই, সবই গল্প।  কেউ কেউ বলে পুরোনো বইগুলো অনেক মিস করি। কারণ, ওই বইগুলো পড়তে ভালো লাগত, অনেক কিছু শিখতে পারতাম। তা ছাড়া পরীক্ষাপদ্ধতি থাকায় প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে পড়ার প্রতি আকৃষ্ট হতে পারতাম।

এ ছাড়া শিক্ষকেরা নতুন কারিকুলামের বইয়ের পাঠগুলো নিজেরাই আত্মস্থ করতে পারেনি, প্রশিক্ষিতও না, শিক্ষার্থীদের কীভাবে সহজভাবে বুঝিয়ে পড়াবে। নতুন শিক্ষাক্রমের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীরা যেন প্রাইভেট পড়া ছাড়াই বই পড়ে বুঝতে পারে অথচ দেখা মিলছে ভিন্ন চিত্রের। ঘরে ঘরে টিউটর মাস্টার, রাত–দিন ছক পূরণ, হাতের কাজ ইত্যাদি করতে গিয়ে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক দুই-ই নাজেহাল।

আশা করি, সরকার শিক্ষা নিয়ে কথা বলার অধিকারটুকু হনন করবে না। শিক্ষায় অন্তত গণতন্ত্রের চর্চাটুকু থাকুক। পরিবর্তন নিয়ে আসাই বিশেষত্ব নয়; বরং পরিবর্তনটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য এবং ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা–ই মুখ্য বিষয়। তাই নতুন শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীদের জন্য কতটুকু বহনযোগ্য, উপকারী, বোধগম্য তা তালাশ করা জরুরি। এই পরিবর্তন যেন শিক্ষার্থীদের বই এবং বিদ্যালয়বিমুখ করে গড়ে না তোলে, সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নজর দেওয়া জরুরি।

নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর শিক্ষকদের যেমন খুব দখল নেই, তেমনি অভিভাবকেরাও এর সঙ্গে পরিচিত নন। ফলে বাসায় বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে দেওয়া বাড়ির কাজগুলো মোবাইলের মাধ্যমে সম্পন্ন করে। এতে ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে মোবাইল আসক্তির বীজ, বেড়ে উঠছে এই নতুন মাদকের চাহিদা। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে তরুণ প্রজন্মও আক্রান্ত হচ্ছে এই আসক্তির ব্যাধিতে।

আমরা সত্যিই চাই, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একটি আমূল পরিবর্তন আসুক। আমরা চাই, যে শিক্ষা গ্রহণ করলে দেশ থেকে পালাতে হবে না, যে শিক্ষা গ্রহণ করলে দেশে পারদের মতো দ্রব্যমূল্য উঠবে না, যে শিক্ষা পেলে ‘সাদাটাকা’ ‘কালোটাকা’ শব্দ পত্রিকার শিরোনাম হবে না, আমরা এমনই একটি শিক্ষা চাই। চাই তেমন শিক্ষা, যা পেলে সমালোচনা করার জন্য জেলে যেতে হয় না।

আমরা এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা চাই, যা পেলে ন্যায্য ভোটের জন্য হাহাকার করতে হবে না, বাস-ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ মারা হবে না, রোগীর গাড়ি আটকিয়ে মন্ত্রীদের গাড়িবহর যাবে না। আমরা এমন শিক্ষাব্যবস্থা চাই, যা পেলে লাখ লাখ বেকার যুবক–যুবতী ভবঘুরের মতো দেশে থাকতে হবে না একটা চাকরির আশায়, যার মাধ্যমে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে সবাই দেশেই নিজের মেধা বিকাশ করতে পারে এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গড়ে তুলতে পারে।

এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা পাওয়ার জন্য আমাদের আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ দিতে হবে। দলমত-নির্বিশেষে শিক্ষার জন্য শিক্ষাবিদদের এক ঘরে আনতে হবে।

আশা করি, সরকার শিক্ষা নিয়ে কথা বলার অধিকারটুকু হনন করবে না। শিক্ষায় অন্তত গণতন্ত্রের চর্চাটুকু থাকুক। পরিবর্তন নিয়ে আসাই বিশেষত্ব নয়; বরং পরিবর্তনটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য এবং ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা–ই মুখ্য বিষয়। তাই নতুন শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীদের জন্য কতটুকু বহনযোগ্য, উপকারী, বোধগম্য তা তালাশ করা জরুরি। এই পরিবর্তন যেন শিক্ষার্থীদের বই এবং বিদ্যালয়বিমুখ করে গড়ে না তোলে, সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নজর দেওয়া জরুরি।

  • ইসরাত জাহান
    লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।