উচ্চশিক্ষায় এক আতঙ্কের নাম সেশনজট

উচ্চমাধ্যমিক সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে হাজারো শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার দুয়ারে প্রবেশ করেন। অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে উচ্চশিক্ষা, তথা বিশ্ববিদ্যালয় নামের সোনার হরিণ জোটে সীমিতসংখ্যক শিক্ষার্থীর ভাগ্যে। দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে। কিন্তু এই সফলতায় যেন একদিন কাল হয়ে দাঁড়ায়, সুন্দর স্বপ্ন পরিণত হয় হতাশায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আক্রান্ত হয় সেশনজট নামের ভয়াবহ ব্যাধিতে।

বর্তমানে উচ্চশিক্ষা, তথা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের এটি মারাত্মক সমস্যা হলো সেশনজট। দেখা যায়, সেশনজটের কারণে চার বছরের স্নাতক (সম্মান) শেষ করতে লেগে যায় ছয়-সাত বছর, যা একজন শিক্ষার্থীর জীবনে নিয়ে আসে হতাশা ও দুশ্চিন্তার ভাঁজ। ক্যারিয়ার ও চাকরিজীবনে সৃষ্টি করে নানা প্রতিবন্ধকতা।

সেশনজটের কবলে পড়ে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে এসে অসীম সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়েও একজন শিক্ষার্থী হতাশ হয়ে যান। এই অভিশাপের কারণে উচ্চশিক্ষায় পদার্পণ করা শিক্ষার্থী তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগেন। নিজের লক্ষ্য থেকে সরে যান। যে সময় তাঁর কর্মজীবনে পদার্পণ করার কথা ছিল, সে সময় তিনি স্নাতক শেষ করার জন্য দিন গোনেন। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নানাবিধ সমস্যা থেকে আসে মানসিক চাপ, যা থেকে সৃষ্টি হয় বিষণ্নতা।

সবার স্বপ্ন থাকে, একসময় পড়াশোনা শেষ করে দেশের এবং বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করবেন। পরিবারের দুঃখকষ্ট লাঘব করবেন। হয়ে উঠবেন পরিবারের ভরসার প্রতীক। কিন্তু এই সেশনজট নামের আতঙ্কের কাছে শেষ হয়ে যায় সব স্বপ্ন। স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে জীবন থেকেই ঝরে পড়ছেন মেধাবী শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে স্বপ্ন শেষ হয়ে যাচ্ছে তাঁদের পরিবারের স্বজনদের।

সেশনজটের কারণে সৃষ্ট একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা হলো সামাজিক চাপ। স্নাতকের শুরুর দিকে সামাজিক কোনো চাপ না থাকলেও স্নাতকের শেষের দিকে হাজারো সামাজিক চাপের বোঝা লক্ষ করা যায়। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট—সব জায়গায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। এসব কারণে শিক্ষার্থীরা এলাকায় যেতেও হীনম্মন্যতায় ভোগেন। যে কারণে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন।

এ ছাড়া সেশনজটের কারণে তৈরি হয় নানাবিধ অর্থনৈতিক চাপ। উচ্চশিক্ষার অধিকাংশ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। সেই কারণে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জীবনের শুরু থেকেই আর্থিক চাপের মুখে পড়তে হয়। পরিবার থেকে আসতে থাকে নিজের খরচ জোগানোর তাগিদ। এমন সময় শিক্ষার্থীরা পরিবারের কাছে খরচের টাকা চাইতে হীনম্মন্যতায় ভোগেন। যে কারণে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।

সেশনজট কতটা ভয়াবহ, তার দৃষ্টান্ত এই যে এর কবলে পড়ে অসংখ্য শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ পর্যন্ত বেছে নিচ্ছেন। যেমন তীব্র সেশনজটে হতাশাগ্রস্ত হয়ে গত বছর ২০২২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পল্লবী মণ্ডল আত্মহত্যা করেছিলেন।

এমন অবস্থায় সেশনজট নামের এই ভয়াবহ ব্যাধি রোধ করতে বা কমিয়ে আনতে দরকার ছাত্র-শিক্ষক উভয়ের এগিয়ে আসা। উভয়কেই হতে হবে আন্তরিক। এ জন্য কোর্সভিত্তিক ক্লাসের সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে হবে। যেমন আগের সপ্তাহে একটি কোর্সের দুটি ক্লাস থাকলে এখন সেখানে চারটি করে ক্লাস দিতে হবে। কোর্সের ক্লাস তিনটি থাকলে সেখানে ছয়টি করে দিতে হবে। এভাবে সব কোর্স দ্বিগুণ ক্লাস করার নিয়ম চালু করতে হবে। প্রয়োজন হলে আরও বেশি করে দিতে হবে।

এ জন্য ছুটি কমিয়ে সেই দিনগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। সময়মতো কোর্সভিত্তিক পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে এবং যথাসময়ে ফলাফল প্রকাশ করতে হবে। সর্বোপরি, কোনো শিক্ষক যেন কোনো শিক্ষার্থীর স্বপ্নভঙ্গের কারণ না হন, শিক্ষকেরা যেন হন শিক্ষার্থীদের সব থেকে বড় আশ্রয়, স্বপ্ন গড়ার কারিগর।

ইদুল হাসান ফারহান
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
ই-মেইল: mdedulhasaniu96@gmail