ভর্তি ও নিয়োগ পরীক্ষায় ‘প্রক্সি’ বন্ধ হবে কবে

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যের হয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসায় মো. সুমন নামের একজনকে আটক করা হয়েছে। গত শনিবার গুচ্ছভুক্ত ২২টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগের (বি ইউনিট) ভর্তি পরীক্ষায় এই ঘটনা ঘটে।
ছবি: প্রথম আলো

শিক্ষাক্ষেত্রে অশুভ সিন্ডিকেট একটি জাতি ধ্বংস ডেকে নিয়ে আসতে পারে। প্রতিবছর শিক্ষাক্ষেত্রে ঘটতে থাকা প্রক্সি সিন্ডিকেট এমনই একটি ভীতিকর সংকেত। বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা, এমনকি চাকরির পরীক্ষায় একদল মেধাবী কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষার্থী এবং কিছু অসাধু অভিভাবক ও পরীক্ষার্থী প্রক্সি সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন।

গত ১৩ আগস্ট অনুষ্ঠিত মানবিক ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রে প্রক্সি দিতে এসে ধরা পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা আবির নামের এক শিক্ষার্থী। যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জসিমউদ্দিন হলের একজন আবাসিক ছাত্র। তিনি একা নন, এই সিন্ডিকেটে তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সিজান ও রাব্বি নামের আরও দুজন। সিজান ও রাব্বির পরামর্শ, প্ররোচনা ও সহযোগিতায় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকায় প্রক্সি পরীক্ষা দিতে রাজি হন আবির। পরীক্ষার পর তাঁর কাছ থেকে জব্দ হওয়া এটিএম কার্ডে ২৬ লাখ টাকা পাওয়া যায়।

এর আগে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় জুলকারনাইন শাহী নামের এক পরীক্ষার্থীর পরীক্ষায় ১০ হাজার টাকায় প্রক্সি দেন মাসুদ সরকার নামের একজন শিক্ষার্থী, যিনি ছিলেন বিসিএস পরীক্ষার্থী। তিনি পড়তেন কারমাইকেল কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ে। তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে স্নাতকোত্তর করা এক শিক্ষার্থী। ২০২১-২২ সেশনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ইউনিটে প্রক্সি পরীক্ষা দিয়ে উক্ত ইউনিটে প্রথম হয়েছিলেন বায়োজিদ নামের এক শিক্ষার্থী। যিনি তানভীর নামের এক শিক্ষার্থীর হয়ে পরীক্ষা দেন। প্রক্সি পরীক্ষায় ধরা পড়ার পরও প্রকাশিত হয় তাঁর ফলাফল। সেই দিন এ ইউনিটের পরীক্ষায় এক নারীসহ চারজনকে আটক করা হয়েছিল প্রক্সিতে জড়িত থাকার অভিযোগে। তাঁদের মধ্যে একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষার্থী, যার নাম এখলাছুর রহমান। তিনি লিমন নামের এক শিক্ষার্থীর প্রক্সি পরীক্ষা দেন। তাঁকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অন্যজন নারী শিক্ষার্থী, যাঁর নাম জান্নাতুল মেহজাবিন, তিনি লোকপ্রশাসন বিভাগের। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাঁকে দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি ইশরাত জাহান নামের এক শিক্ষার্থীর প্রক্সি পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন। বাকি দুজন পরীক্ষার্থীর ফলাফল এসেছিল এক্সফেলড।

শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন, ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিয়ে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন সমের রায় নামের একজন চিকিৎসক। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিয়ে ধরা পড়েছিলেন। যিনি একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের প্রভাষক। তাঁকে এক বছর এবং যার হয়ে প্রক্সি পরীক্ষা দিলেন সেই রাহাত আমিনকে এক মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

শুধু ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষায় নয়, কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষায় ৩০ হাজার টাকা চুক্তিতে ২০২১ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছিলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবুল খায়ের আরাফাত নামের এক শিক্ষার্থী। যিনি হিসাববিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক শেষ বর্ষে অধ্যয়নরত ছিলেন। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল শিক্ষার্থী ছাড়াও দেশের অন্যতম সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৌহিদুল হাসান শিপন (২৯) নামের এক শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। তাঁকে মাত্র সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মাত্র ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিসর্জন দেন নৈতিকতা। আবার ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে চান্স প্রাপ্তির পর ভর্তির সময় সাক্ষাৎকার দিতে এসে ধরা পড়লেন ইকবাল হোসেন সাইদ নামের এক শিক্ষার্থী। ভর্তি পরীক্ষার স্বাক্ষরের সঙ্গে ভর্তির দিনের স্বাক্ষরের মিল না থাকায় ধরা পড়েন তিনি। তিনি বলতে পারেননি পরীক্ষাকেন্দ্রের নাম, এমনকি কিছু সাধারণ প্রশ্নও। এভাবেই যোগ্য পরীক্ষার্থীর স্থান দখল করে অযোগ্য শিক্ষার্থী।

এভাবে বছরের পর বছর ধরে চলছে প্রক্সি দেওয়া। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাময়িক শাস্তির বিধান করা হলেও স্থায়ীভাবে এ প্রক্সি বন্ধ করা যাচ্ছে না। কেউ কেউ হয়তো ধরা পড়ছেন। কিন্তু সিন্ডিকেটের বড় অংশই রয়ে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। টাকার কাছে বিক্রি করছে মেধা, নৈতিকতা, আদর্শ ও সম্মান। অনৈতিক দুর্নীতিগ্রস্ত মেধাবী শিক্ষার্থী দ্বারা একটি শিক্ষিত, নৈতিক, দেশের প্রতি নিষ্ঠাবান চাকরিজীবী শ্রেণি আশা করা যায় না। যাঁর স্থানে প্রক্সি দেওয়া হয় সে–ও দুর্নীতিগ্রস্ত ও অযোগ্য পরীক্ষার্থী। প্রক্সি সিন্ডিকেটের আশ্রয় নেওয়া অভিভাবকদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে। প্রক্সি সিন্ডিকেটকে নির্মূল করতে প্রয়োজনে আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তি (যেমন ফিঙ্গারপ্রিন্ট) এর সাহায্য নিতে হবে।

প্রক্সিদাতা ও যাঁর জন্য প্রক্সি দেওয়া হয়, তাঁরা ও তাঁদের পরিবারের দুর্নাম তো হয়ই, আর্থিকভাবেও তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। পাশাপাশি ধরা না পড়লে একজন যোগ্য পরীক্ষার্থী আসন হারান এবং অযোগ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষার্থী সুযোগ পান। ভবিষ্যতে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়। দুর্নীতি করা মেধাবী প্রক্সিদাতা দ্বারা দুর্নীতিমুক্ত সুশীল সমাজ ভাবা যায় না।

একটি অশিক্ষিত দুর্নীতিগ্রস্ত জাতি যেমন রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর, একইভাবে একটি শিক্ষিত দুর্নীতিগ্রস্ত জাতির বেলায়ও সেটি সত্য। দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের মেধাবী মুখগুলোর নৈতিকতার বিসর্জন টাকার বিনিময়ে না হোক এমনটাই প্রত্যাশা সবার। তাই প্রক্সি সিন্ডিকেট বন্ধে এখনই উদ্যোগী হতে হবে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে। যোগ্য শিক্ষার্থীর আসন হোক, প্রক্সি সিন্ডিকেট নির্মূল হোক।


আফিয়া সুলতানা একা
শিক্ষার্থী
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: [email protected]