এক রাজকুমারীর বিরহগাথায় গড়ে ওঠেছিল যে মন্দির

এগারো শিব মন্দিরের বর্তমান রূপ

যশোরের অভয়নগর উপজেলায় অবস্থিত এগারো শিব মন্দির একটি প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। এই মন্দিরগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক দুঃখী রাজকুমারীর গল্প।

পৌষের কুয়াশায় ঢাকা প্রকৃতি যেন এক অলৌকিক দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। শীতের রেশ তখনো মিলিয়ে যায়নি। এমন সময়ে আমরা খুলনা থেকে যশোরগামী গাড়িতে চেপে বসলাম। গাড়ি চলতে চলতে প্রকৃতির রূপ বদলাতে থাকে। কুয়াশা কেটে যায়, আকাশে দেখা যায় রোদের আলো। গাড়ি ফুলতলা বাসস্ট্যান্ড পৌঁছালে আমরা নামলাম। এরপর চলন্ত ভ্যানে করে অভয়নগরের উদ্দেশ্য চললাম আমি এবং আমার দাদা রুপক মল্লিক। ফুলতলা থেকে অভয়নগর যেতে আরও কিছুটা সময় লাগে। আমরা গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। গ্রামের রাস্তাঘাট খুবই মসৃণ। দুপাশে সবুজ খেত আর গাছপালা। প্রকৃতির এই মনোরম দৃশ্য আমাদের মন ভরিয়ে তুলল।

অবশেষে আমরা অভয়নগর পৌঁছালাম। গ্রামের মাঝখানে একটি ছোট্ট মন্দির দেখা যাচ্ছে। মন্দিরটির নাম, অভয়নাথ মন্দির।

যশোরের তৎকালীন রাজা নীলকণ্ঠ রায়ের একমাত্র কন্যা ছিলেন অভয়া। তিনি ছিলেন একজন সুন্দরী ও গুণবতী রাজকুমারী। তাঁর বিয়ে হয় নড়াইলের জমিদারের ছেলে নীলাম্বর রায়ের সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পর নীলাম্বর দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। অল্প বয়সেই বিধবা হন অভয়া।

সে সময়ে হিন্দু ধর্মে বিধবাদের জন্য দ্বিতীয় বিবাহের কোনো নিয়ম ছিল না। তাই অভয়াকে বাকি জীবন বিধবা অবস্থায় থাকতে হয়। তিনি তাঁর বাবার সঙ্গে ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত অভয়নগরে বসবাস করতেন।

অভয়া ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ নারী। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি শিবকে ভক্তি করতে শুরু করেন। তিনি তাঁর বাবার কাছে শিব মন্দির নির্মাণের অনুরোধ করেন। রাজা মেয়ের অনুরোধে ১৭৪৫ সাল থেকে ১৭৬৪ সালের মধ্যে ১১টি শিব মন্দির নির্মাণ করেন।

মন্দিরগুলো সংস্কার করে সেগুলোর ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য রক্ষা করা উচিত।

এই মন্দিরগুলোর প্রতিটিই স্থাপত্যগত দিক থেকে অনন্য। প্রতিটি মন্দিরের সামনে রয়েছে একটি চমৎকার তোরণ। মন্দিরের ভেতরের দেয়ালে রয়েছে বিভিন্ন শিল্পকর্ম।
কথিত আছে, রাতের বেলায় এই মন্দিরের ভেতর থেকে এক নারীর কান্নার শব্দ শোনা যায়। লোকজনের বিশ্বাস, সেই কান্নার শব্দ অভয়ার। তিনি তাঁর স্বামীর জন্য মন্দিরে এসে কান্না করেন।

এগারো শিব মন্দির বাংলাদেশের একটি অনন্য স্থাপত্য নিদর্শন। প্রতি বছর শীতকালে এখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি বড় উৎসব হয়। উৎসবে বিভিন্ন জায়গা থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এখানে আসেন।

এ মন্দিরগুলোর স্থাপত্যশৈলী অত্যন্ত সুন্দর ও অনন্য। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই মন্দিরগুলোর স্থাপত্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই এই মন্দিরগুলো সংরক্ষণের জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। মন্দিরগুলোর দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। অনেক জায়গায় ইট ও কাঠ খসে পড়েছে। এই মন্দিরগুলো সংস্কার করে সেগুলোর ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য রক্ষা করা উচিত।

সৌরভ হালদার
শিক্ষার্থী, ব্যবস্থাপনা বিভাগ
সরকারি ব্রজলাল কলেজ খুলনা