উত্তরবঙ্গের নিম্নবিত্তদের দিকে তাকান

ঘরে চাল নেই। মাঠে কাজ নেই। বাজারের অবস্থা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। উত্তরবঙ্গের বেশির ভাগ মানুষের নিজস্ব কোনো জমি নেই। কেউ বর্গা নিয়ে আবাদ করেন, আবার কেউ কয়েক শতাংশ কিংবা এক বিঘা নিজের জমি আবাদ করেন। সেখান থেকে যতটুকু ধান পান, তা দিয়ে যত দিন যায়, বাকি দিন পরের জমিতে খেটে অথবা শহরে রিকশা চালিয়ে চাল ও অন্যান্য সামগ্রী কিনে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। এতে কিছু ধারকর্জ হয়ে যায়, যা পরবর্তী সময়ে ধান পেলে কিছু বিক্রি করে পরিশোধ করতে হয়। যাঁদের বাড়িভিটা ছাড়া কোনো আবাদি জমি নেই, দিনমজুরিই তাঁদের সম্বল।

এটা হলো উত্তরবঙ্গের খেটে খাওয়া মানুষের স্বাভাবিক চিত্র। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। করোনা মহামারির কারণে যে সময়টা উত্তরবঙ্গের চাষিরা শহরে রিকশা চালাতে যান, তাঁরা এবার যেতে পারেননি। ফলে যেটুকু সঞ্চয়, তা তখনই শেষ হয়ে গেছে, যেটা খরচ হওয়ার কথা ছিল মৌসুমের শেষের দিকে। করোনার প্রকোপ থেকে গ্রাম এলাকাও কিন্তু মুক্ত নেই, যার ফলে কাজ বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন। একই সঙ্গে এবারের অধিকাংশ ফসলি জমিতে বিভিন্ন রোগের আক্রমণের আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই ফসল গতবারের তুলনায় অর্ধেকের কম হতে পারে। বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগও এবার উত্তরবঙ্গ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশিই দেখেছে। এ অবস্থায় খুব জানতে ইচ্ছা হলো কেমন আছেন উত্তরবঙ্গের নিম্নবিত্তের মানুষগুলো। সরেজমিনে দেখতে ছুটে বেড়ালাম কিছু এলাকা এবং কথা বললাম কয়েকজনের সঙ্গে। সেই অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।

কিছু পরিবার আছে, যারা না খেয়েও থাকে কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতেও তাদের আত্মসম্মানে লাগে। তবে তাদের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায় তারা কতটা কষ্টে আছে। এর মাঝে আছে আবার বিভিন্ন এনজিওর কিস্তি। ঋণ নিয়ে আবাদ করেছেন, এখন আবাদ হয়েছে কি না, তা দেখার সময় এনজিওওয়ালাদের নেই। সপ্তাহে সপ্তাহে তাদের কিস্তি তারা আদায় করেই ছাড়বে। এতে কেউ না খেয়ে থাকুক আর মরে যাক, তাদের কিছু আসে-যায় না।

সবজির দোকানগুলোতে ক্রেতা নেই, মুদির দোকানে বেচাকেনা নেই। ছোট ছোট বাজারের প্রাণই হলেন কৃষক। কিন্তু যেখানে কৃষক-দিনমজুরের ঘরে চাল নেই, সেখান মুদির দোকানে ক্রেতা না থাকাটাই স্বাভাবিক। এমন একজন ক্ষুদ্র মুদিদোকানি পেলাম ঝিনিয়া বাজারে। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে দোকান দিয়েছিলেন কিন্তু বেচাকেনা না থাকলেও কিস্তি দিতে দিতেই এখন সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন।

যদিও কেউ দু-এক দিন কাজ পান, তাঁর মজুরি সর্বোচ্চ ২৫০ টাকা। তা নিয়ে বাজারে ঢুকলে কী কী কেনা যায় আর কত টাকা নিয়ে ফেরা যায়, তা বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

এভাবে না খেয়ে থাকতে থাকতে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মেজাজ হয়ে যাচ্ছে রুক্ষ। সংঘটিত হচ্ছে মারামারি, খুন ও ধর্ষণের মতো অপরাধ।

করোনার এই মহামারি কবে শেষ হবে, কেউ জানে না। দেশের বিজ্ঞজনেরা মনে করছেন, শীতকালে এর প্রকোপ আরও বাড়তে পারে। এ অবস্থায় শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকিই নয়, মৃত্যুর ঝুঁকিও বেড়েই চলেছে। যাদের পেটে ভাত নেই, তাদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে বলা কিংবা মানতে বাধ্য করা কতটা যৌক্তিক, তা আমি জানি না। তবে দেশের ভিত্তি, এই সাধারণ মানুষগুলোর করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার পর কী অবস্থা হবে, তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। দেশের কর্তাব্যক্তিদের কাছে প্রাণভরে একটা জিনিসই চাওয়ার আছে, এরা গ্রামের মূর্খ মানুষ। এরা সিন্ডিকেট বোঝে না। এরা রাজনীতি নিয়ে কখনো মাথা ঘামায় না। আপনারা এদের কাছে আসুন, এদের মনের কথাগুলো শুনুন। এদের দুমুঠো ভাত দিয়ে, একটা কাজ দিয়ে সন্তুষ্ট করুন।

*হাসান আলী: সদস্য, তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা