এমন বাংলাদেশ কি আমরা প্রত্যাশা করি?

সংখ্যালঘুদের ওপর হামলায় প্রতিবাদ সমাবেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৪ অক্টোবর
ছবি: প্রথম আলো

সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প উসকে দিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় উপমহাদেশে ২০০ বছর শাসন টিকিয়ে রাখে। আবার যখন ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলো, তখন আমরা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলাম। ধর্মের ভিত্তি পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানকে এক ঘরে রাখতে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে এ দেশের আপামর জনতা প্রতিবাদ করতে থাকে। ফলে নানা ধর্মের মানুষের সম্প্রীতির পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে বিশ্বের বুকে সার্বভৌম বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের নাম ধারণ করে। তখন থেকেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সূচনা।

বিশ্বে বিদ্যমান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সবচেয়ে বড় উদাহরণ বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে লেখক আহমদ ছফাও বলেছিলেন, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক দেশ হলো বাংলাদেশ। আমাদের সংবিধানেও নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলা আছে। সংবিধানের ৪১(১ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিকের যে কোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে। সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাত কোনো জাতির কল্যাণ বয়ে আনে না। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় না থাকলে সাধারণ নাগরিকদের ক্ষতি এবং রাষ্ট্র প্রদত্ত মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। পাশাপাশি রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রাও বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অর্থাৎ সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে গেলেও এখনো দেশের ভেতরে একদল স্বার্থান্বেষী মানুষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চেষ্টায় লিপ্ত। সম্প্রতি কুমিল্লা নগরীর নানুয়ার দিঘিরপাড়ের একটি ঘটনা নিয়ে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টে নেমেছে তারা। অভিযোগ উঠেছে, ওই এলাকার দুর্গাপূজার মণ্ডপে কে বা কারা হনুমানের মূর্তির কোলে পবিত্র কোরআন শরিফ রেখেছে। স্বাধীন–সার্বভৌম একটি দেশে এমন স্পর্শকাতর ঘটনা কখনোই প্রত্যাশার নয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো গোষ্ঠী এমন কাজ সংঘটিত করে থাকে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছু লোক আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে, যা কাম্য নয়।

বিবেকবান, মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন মানুষ কখনো অন্য ধর্মের পবিত্র গ্রন্থকে যেমন অবমাননা করতে পারে না, তেমনি সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা এবং পূজামণ্ডপে ভাঙচুরও চালাতে পারে না। কুমিল্লার পূজামণ্ডপের ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাজীগঞ্জ, নোয়াখালীর চৌমুহনীসহ অনেক জেলা–উপজেলায় অনেক মন্দিরে হামলা ও সংঘর্ষে নিহতের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা বিচার বিভাগীয় কমিটি দ্বারা সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষভাবে তদন্তের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার প্রথমে ভাবতে হবে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান—আমরা সবাই একই রক্ত–মাংসে গড়া মানুষ। মনে রাখতে হবে একই রাষ্ট্রের নাগরিক আমরা, সবার অধিকারও সমান। চণ্ডীদাস যথার্থই বলেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ আর আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে না; কেননা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা ধর্মীয় বিষয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে।’ বিষয়গুলো আমরা সবাই জানলেও উপলব্ধি করি না। আসুন, সম্প্রীতির বাংলাদেশ টিকিয়ে রাখতে আমরা নিরাপদ সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তুলি, যেখানে সব সম্প্রদায়, ধর্ম, জাতি ও বর্ণের মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত হবে।

ফজলে রাব্বি
শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা কলেজ।