ক্লিন ফিড বিদেশি চ্যানেল, অহেতুক বিরক্তির অবসান

বহুদিন পর টিভি দর্শকেরা এক অহেতুক উৎপাত থেকে মুক্তি পেলেন। সরকার ১ অক্টোবর থেকে বিদেশি চ্যানেলের অনুষ্ঠান বিজ্ঞাপনমুক্তভাবে (ক্লিন ফিড) প্রচারের নির্দেশ কার্যকর করেছে। সরকারি এ আদেশে বিদেশি চ্যানেলের পছন্দমতো অনুষ্ঠান দর্শকেরা নির্ঝঞ্ঝাটে উপভোগ করতে পারবেন। এবার বিজ্ঞাপন বিরতির জন্য অনুষ্ঠান দেখার আমেজ নষ্ট হবে না।

কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন, ২০০৬-এর ১৯-এর ১৩ উপধারায় বাংলাদেশে দর্শকদের জন্য বিদেশি কোনো চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না মর্মে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। কিন্তু কার আইন কে মানে। পরিষ্কার আইন থাকা সত্ত্বেও কেবল অপারেটর ও পরিবেশকেরা আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বছরের পর বছর অবাধে বিজ্ঞাপনের বহর ঢুকিয়ে বিদেশি চ্যানেল প্রচার করে যাচ্ছেন।

বিজ্ঞাপনমুক্ত বিদেশি চ্যানেল প্রচারের একই আইন প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কঠোরভাবে অনুসৃত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের ব্যাপারে যত ওজর-আপত্তি। আসলে আইন প্রণীত হওয়ার পর যদি প্রয়োগে শিথিলতা থাকে, তা হলে আইনের স্পিরিট নষ্ট হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে সুবিধাভোগীদের মধ্যে আইনের নিষ্ক্রিয়তায় ফায়দা লুটার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। অবশ্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এক শ্রেণির কর্মচারীদের সঙ্গে মিলেমিশেই ব্যবস্থা চলে। আইনের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে দীর্ঘদিনের পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত হঠাৎ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সুবিধাভোগী মহলকে এত ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে।

কেবল অপারেটরদের ওপর বিজ্ঞাপনমুক্ত অনুষ্ঠান প্রচারের সরকারি নির্দেশ হঠাৎ চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, দুই বছর আগে থেকেই সরকার অপারেটরদের সংস্থা কোয়াব এবং পরিবেশকদের ক্লিন ফিড নীতিমালা অনুসরণ করে বিদেশি চ্যানেল প্রচারের জন্য তাগিদ দিয়ে আসছিল। কিন্তু সরকারের অনুরোধ-উপরোধে যখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কর্ণপাত না করে, তাঁদের মতো করে বিজ্ঞাপনের ডালি নিয়ে চ্যানেল প্রচার করে যাচ্ছিলেন, তখনই সরকার ১ অক্টোবর থেকে ক্লিন ফিড নীতিমালা অনুসরণ না করে অনুষ্ঠান প্রচার করতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

ভাবলে অবাক লাগে, আইনানুগ সরকারি নির্দেশ জারি হওয়ার পর কেবল অপারেটর কর্তৃপক্ষ ক্ষোভের সঙ্গে জানায় বিজ্ঞাপনমুক্ত বিদেশি চ্যানেল প্রচার তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এত ধৃষ্টতা প্রদর্শনের সাহস কোথা থেকে আসে! অধিকন্তু সরকারি নির্দেশের পর অপারেটররা যুগপৎ বিদেশি সব চ্যানেল প্রচার বন্ধ করে দেন। বাজারে জোর গুজব ছড়ানো হয়, সরকার বিদেশি সব চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু সরকার যে বিজ্ঞাপনমুক্ত চ্যানেল প্রচারে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করেনি, এ কথা বুঝতে দর্শকদের একটু সময় লাগে। এখন পর্যন্ত ক্লিন ফিড নীতিমালা অনুসরণ করে অপারেটররা বিজ্ঞাপনমুক্ত বিদেশি চ্যানেল প্রচার না করে একদিকে দর্শকদের বিনোদনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছেন, অন্যদিকে অন্যভাবে আইন ও সরকারি নির্দেশের প্রতি অবজ্ঞা-প্রদর্শন করছেন।

ক্লিন ফিড নীতিমালা কার্যকরী করার প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়। বিদেশি চ্যানেলে যেসব পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়, সেগুলোর অধিকাংশই দেশে বহুজাতিক কোম্পানিতে উৎপাদন হচ্ছে। যে পণ্য এ দেশে উৎপাদন হয় না, সেগুলো আমদানি করা হয়। এখন দেশে উৎপাদিত ও বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের বিজ্ঞাপন যদি বাংলাদেশের চ্যানেলে প্রচার করা হয়, সে ক্ষেত্রে দেশীয় চ্যানেলগুলো লাভবান হয়।

প্রসঙ্গত, বিজ্ঞাপনের অভাবে কিছু দেশীয় চ্যানেল অস্তিত্ব-সংকটে ভুগছে বলে গণমাধ্যম সূত্রে প্রকাশ। পক্ষান্তরে সরকারেরও এ খাতে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পায়। সংবাদ সূত্রে প্রকাশ, বিজ্ঞাপনপূর্ণ বিদেশি চ্যানেল দেশে প্রচার করায় সরকার বছরে প্রায় ২০০০ কোটি টাকার রাজস্ব আয় হতে বঞ্চিত হচ্ছে। সূত্রমতে এ-ও জানা যায়, ভারতীয় বিশেষ করে স্টার জলসা, জি বাংলা, কালার বাংলা ইত্যাদি চ্যানেলের বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা তুঙ্গে থাকায় অনেক দেশীয় পণ্যেরও বিজ্ঞাপন উল্লিখিত চ্যানেল থেকে দেশে প্রচার করা হয়। এতে করে দেশীয় উৎপাদকদেরও পণ্যের প্রচারের জন্য ভারতীয় চ্যানেলকে বাড়তি খরচ জোগাতে হচ্ছে।

বিদেশি চ্যানেলে এসব বিজ্ঞাপন প্রচারের হওয়ার সুযোগ না থাকলে আমাদের দেশীয় চ্যানেল সব ধরনের পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করে উপকৃত হতো এবং সরকারও ন্যায্য রাজস্ব প্রাপ্তিতে বঞ্চিত হতো না। সামাজিক মাধ্যম সূত্রে প্রকাশ, আমাদের পণ্য উৎপাদকেরা ভারতীয় মডেল, নির্মাতা, পরিচালক দিয়ে এ দেশের পণ্যের বিজ্ঞাপন নির্মাণ করে ভারতীয় চ্যানেলে প্রচার করছেন, যা আমাদের গেলানো হচ্ছে ক্লিন ফিডবিহীন প্রচারের মাধ্যমে। বিষয়টি বাস্তব হলে বিজ্ঞাপনের নির্মাণ থেকে প্রচার পর্যন্ত পুরো টাকাই বিদেশে চলে যাচ্ছে এবং আমাদের বিজ্ঞাপন নির্মাতারা অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখছেন আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন।

পক্ষান্তরে এ ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক বিষয়টিও বিচার্য। বিদেশি বিজ্ঞাপনে পাত্র-পাত্রীদের পোশাকপরিচ্ছদ, সংলাপ, থিম, অঙ্গভঙ্গি, ফ্যাশন ইত্যাদি অনেক কিছু আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই হয় না। অনেক বিজ্ঞাপনই আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির চলমান রীতি, নৈতিকতার পরিপন্থী এবং বিকৃত রুচির পরিচায়ক। বাঙালিয়ানার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় এর কুপ্রভাব আমাদের যুবসমাজের ওপর পড়ায় সমাজে সুদূরপ্রসারী ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

তথ্যমন্ত্রী বিজ্ঞাপনমুক্ত অনুষ্ঠান প্রচার প্রসঙ্গে বলেন, দেশের আকাশ তো উন্মুক্ত রয়েছে। আইন অনুযায়ী অন্যান্য দেশের মতো এ দেশেও বিজ্ঞাপনমুক্ত দর্শকনন্দিত অনুষ্ঠানের মূল কনটেন্ট প্রচার করলে দর্শকেরা ঝামেলা মুক্ত হয়ে স্বল্প সময়ের সুস্থ বিনোদনের খোরাক পেতে পারেন। এ ছাড়াও ৩০ মিনিটের প্রোগ্রামে যে ১০ মিনিট বিদেশি বিজ্ঞাপন দেখানো হয়, সে ক্ষেত্রে বিদেশি বিজ্ঞাপন না দেখিয়ে এই সময়ে দেশীয় চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেখালে দেশীয় পণ্যের প্রচার আরও সমৃদ্ধ হয় এবং আমাদের চ্যানেলগুলোর রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পায়। সরকারি রাজস্বও এতে ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে। কারণ, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এ বাজারও দিন দিন স্ফীত হচ্ছে।

আইন বাস্তবায়নে বিজ্ঞাপনমুক্ত চ্যানেল সম্প্রচারে কেবল অপারেটর ও পরিবেশকদের অনমনীয়তার ফলে সবচেয়ে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েছেন দর্শকেরা। কারণ, অপারেটররা ক্লিন ফিড করে জনপ্রিয় বিদেশি চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়ায় দর্শকেরা প্রাত্যহিক জীবনে বিনোদনের এক সুযোগ হতে বঞ্চিত হচ্ছেন। ইতিমধ্যে, বিবিসি, সিএনএন, আল-জাজিরাসহ কয়েকটি বিজ্ঞাপনবিহীন বিদেশি নিউজ চ্যানেল সম্প্রচার শুরু হয়েছে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে বাদবাকি জনপ্রিয় চ্যানেলগুলো ও শিগগির শুরু হবে বলে সচেতন মহল আশা করে।

জনস্বার্থে এ দেশে প্রচুর আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে অনেক আইনই অর্থহীন হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে আইনের ঠিকমতো প্রয়োগ না হওয়ায় আইনের সুফল হতে জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে। তবে দেরিতে হলেও বিজ্ঞাপনমুক্ত বিদেশি চ্যানেল প্রচারে সরকার যে দৃঢ় মনোভাব ও পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে সাময়িকভাবে দর্শক বিনোদন থেকে বঞ্চিত হলেও একটা স্থায়ী সমাধান হবে।

শুভ্রেন্দু ভট্টাচার্য সাবেক সরকারি কর্মকর্তা