গণপরিবহন কখন মেয়েদের জন্য নিরাপদ হবে

ফাইল ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীসহ সারা দেশে প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা। এসব মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় যেমন অনেকে প্রাণ হারাচ্ছেন, তেমনি অনেককে বরণ করতে হচ্ছে পঙ্গুত্বের অভিশাপ। সড়কে এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনাগুলোর পাশাপাশি ঘটে চলেছে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা হলেও গণপরিবহনে নারীর নিপীড়িত-নির্যাতনের শিকার হওয়ার বিষয়টি খুব কমই গুরুত্ব পাচ্ছে।

নারী অধিকারকর্মীদের ভাষ্য, সড়কে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা কমাতে নানা পর্যায় থেকে বিভিন্ন দাবি-পরামর্শ উপস্থাপিত হলেও আড়ালেই থেকে যাচ্ছে গণপরিবহনে চলাফেরায় নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি। নারীবান্ধব যানবাহন না থাকাই তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের বড় কারণ। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নারীবান্ধব যানবাহন, চালক ও সহকারী থাকতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে যাত্রীদের মানসিকতায়ও। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, সড়কে নারীর নিরাপত্তার জন্য প্রশিক্ষিত চালকের অভাব একটি বড় সমস্যা। নারীবান্ধব পরিবহনব্যবস্থা গড়তে ও পেশাগত নারী গাড়িচালক তৈরির কার্যক্রম নেই বললেই চলে। নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রমের পাশাপাশি নারী গাড়িচালক প্রশিক্ষিত করার ক্ষেত্রেও নজর দিতে হবে।

গত বছর প্রকাশিত ব্র্যাকের ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী মৌখিক, শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারাই যৌন হয়রানির শিকার হন বেশির ভাগ নারী, এর হার ৬৬। নারীদের যৌন হয়রানির মূল কারণ হচ্ছে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না থাকা, বাসে অতিরিক্ত ভিড়, যানবাহনে পর্যাপ্ত আলোর অভাব ইত্যাদি।

প্রতিনিয়ত নারীকে ঘরে-বাইরে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হচ্ছে। যেমন নগরে নারীর একা চলাচলে নিরাপত্তার অভাব। যানবাহনে চলাচলে নিরাপত্তাহীনতা, প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানি ও আইনের সঠিক প্রয়োগের অনিশ্চয়তা নারীর স্বাধীন চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ ছাড়া অন্যান্য গণপরিবহনেও যাতায়াতকালে নারীরা অসম্মানজনক আচরণেরও শিকার হচ্ছেন। শুধু পরিবহনশ্রমিক, চালক, সহকারী নন, কখনো কখনো পুরুষযাত্রী দ্বারাও এ ধরনের যৌন সহিংসতার শিকার হতে হয় নারীদের। যেমনটি ঘটেছে ২০ নভেম্বর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সব বিভাগেই সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। শনিবার পরীক্ষা থাকায় তিনি গ্রামের বাড়ি নরসিংদী থেকে ঢাকায় যাতায়াতের সময় গণপরিবহনে তাঁর সঙ্গে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। সেদিন সহযাত্রীর হাতে হেনস্তার শিকার হয়েছেন তিনি। কিন্তু সাহসিকতার জোরে বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছেন।

পারিবারিক শিক্ষার অভাব, আইনের সঠিক প্রয়োগ না করা, সর্বোপরি নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসনগুলো সঠিকভাবে পালন না করার কারণে এ ধরনের সামাজিক অবক্ষয় ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে আইন আছে, সমাজে ঘৃণাও আছে। তবু দুষ্ট ক্ষতের মতো বিষয়টি সমাজজীবনে নিরাময়ের অযোগ্য হয়ে আছে। কত নিরপরাধ কিশোরী-তরুণীর জীবন যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধে সামাজিক আন্দোলন বা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি রোধে হাইকোর্টের রায়ের দিকনির্দেশনার অনুকরণে আইন প্রণয়ন করা। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন ও আধুনিকায়ন করে সঠিক ও যথাযথভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বিচার দ্রুত সম্পন্ন করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি, সামাজিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও পাড়ায় পাড়ায় কমিটি গঠন করে তাদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যৌথ উদ্যোগে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

আর কোনো নারী বা শিশু যেন নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের শিকার না হয়। স্কুল বা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গামী কোনো ছাত্রী যেন কোনোভাবে ইভ টিজিং বা যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণের শিকার না হন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের নির্বিঘ্নে যাতায়াতের উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নারী ও শিশু নিপীড়ন, নির্যাতনের মতো অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সম্পর্কে সচেতনতা এবং প্রচারণা দরকার।

সাবরিনা ওবায়েদ আনিকা
শিক্ষার্থী (৩য় বর্ষ), বাংলা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।