গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা কেন এমন ‘জগাখিচুড়ি’ হলো?

গত ১৯ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বৈঠকে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের জন্য ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত হয়। পরে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এই পদ্ধতিতে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। মোট ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়।

দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের যাতায়াত, থাকা নিয়ে অনিশ্চয়তা, খরচসহ বিভিন্ন ভোগান্তি লাঘবের জন্য এ বছর প্রথমবারের মতো গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য—এ তিন ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা ও ফলাফল প্রকাশ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। তবে হঠাৎ করে বিভাগ পরিবর্তনের ইউনিট না রাখার সিদ্ধান্ত, ফি বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে সিলেকশন পদ্ধতিতে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ, যার কারণে শিক্ষার্থীকে দুবার আবেদন ফি ও সেবা চার্জ, পছন্দক্রম অনুযায়ী পরীক্ষাকেন্দ্র না পড়া, কর্মদিবসে পরীক্ষা, ফলাফলে অসামঞ্জস্য এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগকেন্দ্র না থাকায় এ পরীক্ষা নতুন করে দুর্ভোগ তৈরি করেছে। অনেক শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক পরীক্ষা গ্রহণ থেকে ফল প্রকাশ পর্যন্ত পদে পদে দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন।

অনেক শিক্ষার্থীই যাতায়াতসহ অন্যান্য ভোগান্তি লাঘবের কথা ভেবে প্রথমে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্তকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরীক্ষার প্রস্তুতির দীর্ঘদিন পর সিদ্ধান্ত হয় বিভাগ পরিবর্তনের ইউনিট থাকবে না, তখনই তাঁদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রাথমিক ও চূড়ান্ত ধাপে ফলাফলে নির্দিষ্ট শর্ত দেওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী বাদ পড়ে যান। পৃথকভাবে পরীক্ষা হলে একই ফলাফলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরা আবেদন করতে পারতেন। কিন্তু গুচ্ছ পদ্ধতির কারণে তাঁরা সে সুযোগ পাননি। এরপর গুচ্ছের চূড়ান্ত আবেদনে পরীক্ষার ফি প্রথমে ৫০০ টাকা নেওয়ার কথা বলা হলেও, পরে ১০০ টাকা বাড়ানো হয়। সবশেষ ২১ আগস্ট উপাচার্যদের সভায় আরও ৬০০ টাকা বাড়িয়ে মোট ১২০০ টাকা করা হয়, যা অনেকের জন্য কষ্টসাধ্য ছিল।

এ ছাড়া প্রথমে আয়োজক কমিটি থেকে বলা হয়, চট্টগ্রামের শিক্ষার্থী চট্টগ্রামের ভেতরে বা পাশের বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে পারবে। কিন্তু কেন্দ্র পছন্দ দেওয়ার পরও রংপুর, চট্টগ্রাম, বরিশাল কিংবা সিলেটের শিক্ষার্থীর পরীক্ষা ঢাকায়, ঢাকার শিক্ষার্থীর পরীক্ষা বাইরে, এমন দেখা যায়। এ ছাড়া পরীক্ষা ছুটির দিনে না পড়ে কর্মদিবসে পড়ায় চাকরিজীবী অভিভাবকদের ভোগান্তি ও যাতায়াতে সমস্যায় পড়তে হয়।

গত ২৪ অক্টোবর গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের পরীক্ষার পর ২৬ অক্টোবর বিকেল ৫টায় ফলাফল প্রকাশ করা হয়। কিন্তু ফলাফল নিয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, উত্তরের সঙ্গে ফলাফলের মিল নেই। তাঁরা যে কয়টি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, ফলাফলে উত্তরের সংখ্যা কারও বেশি, কারও কম। এতে কেউ উত্তরের থেকে বেশি নম্বর, আবার কেউ কম নম্বর পেয়েছেন। সেদিন রাতেই ওয়েবসাইটে টেকনিক্যাল সমস্যা বলে ফলাফল প্রকাশ বন্ধ রেখে নতুন করে সংশোধিত ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

‘এ’ ইউনিট বিজ্ঞান, ‘বি’ ইউনিট মানবিক এবং ‘সি’ ইউনিট বাণিজ্যের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ‘এ’ ইউনিটে চারটি আবশ্যিক বিষয় যেমন পদার্থ, রসায়ন, বাংলা ও ইংরেজিতে মোট ৬০ নম্বরের পরীক্ষা। এ ছাড়া জীববিদ্যা, গণিত ও আইসিটি তিনটি বিষয়ের মধ্যে যেকোনো দুটি বিষয়ে ৪০ নম্বরের পরীক্ষা। পরীক্ষার্থীরা কোন দুটি বিষয় পরীক্ষা দিলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন কোন বিষয়ে ভর্তির জন্য অপশন দিতে পারবেন, বিজ্ঞপ্তিতে সে বিষয়ে উল্লেখ না থাকায় তাঁরা সিদ্ধান্তহীনতায় পড়েছেন। এ রকম নানান ভোগান্তি ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে শেষ হলো এ বছরের গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম।

ইতিমধ্যেই গুচ্ছের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে (খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি বিজ্ঞপ্তি ও আবেদনের সময়সীমা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেখানেও রয়ে গেছে ধোঁয়াশা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিজ্ঞপ্তিতে বিভিন্ন বিভাগে ভর্তির জন্য ভর্তি পরীক্ষার স্কোর না দেখে উচ্চ মাধ্যমিকের নির্দিষ্ট বিষয়ে নির্দিষ্ট গ্রেড থাকার শর্ত জুড়ে দেয়। তাই এ বছরের করোনা মহামারির কারণে অটোপাস করা শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিকের ফলাফলের অনুপাতে উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল পেয়েছেন, যার কারণে যাঁরা পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফলাফল করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন তাঁরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এ রকমই একজন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী মো. ফেরদাউসের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, তাঁর উচ্চমাধ্যমিক নির্বাচনী পরীক্ষা ও গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজিতে ও সর্বমোট স্কোর ভালো থাকা সত্ত্বেও অটোপাসের কারণে মাধ্যমিকের ইংরেজি রেজাল্ট গণনা করায় অনেকটাই হতাশ তিনি। আদৌ কোনো ভালো সাবজেক্ট পাবেন কি না, তা নিয়ে হতাশায় রয়েছেন।

মো. ওমর ফারুক
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়