জাতীয় পতাকা হোক সমুজ্জ্বল

আমাদের জাতীয় পতাকা অর্জন ও সেটিকে বিশ্বদরবারে সমুজ্জ্বল করার পেছনে আছে একঝাঁক সাহসী মানুষের আত্মত্যাগ। আমাদের সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আমাদের প্রেরণার উৎস। আমাদের সাহসের বাতিঘর।

১৯৭১ সালের ২ মার্চ মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা ডাকসু নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে সবুজ জমিনের মধ্যে লাল বৃত্তের পতাকা উত্তোলন করেন ডাকসুর তৎকালীন সভাপতি আ স ম আবদুর রব। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন ও শাজাহান সিরাজ। পরের দিন ৩ মার্চ এক জনসভায় জাতীয় সংগীত গাওয়ার সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন শাজাহান সিরাজ। বিদেশের মাটিতে ভারতের কলকাতায় ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল ডেপুটি হাইকমিশনের প্রধান এম হোসেন আলী প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন।

এই দিন ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক সমাবেশের ঘোষণা দেওয়া হয়। জাতীয় পতাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম উত্তোলন করেন ২৩ মার্চ ১৯৭১ সালে, ধানমন্ডিতে নিজ বাসভবনে। তবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তৈরির পটভূমি আরও বিশাল। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় সত্ত্বেও ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় এ দেশের জনগণ বুঝে গিয়েছিল ইয়াহিয়া খানের ছলচাতুরী। তাঁরা বুঝে গিয়েছিল ক্ষমতাসীনেরা আমাদের আপনজন নয়।

বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার নকশাকার কামরুল হাসান। তবে প্রথম মানচিত্রখচিত পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাস। ১৯৭০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ১১৬ নম্বর (বর্তমান ১১৭-১১৮) কক্ষে তৎকালীন ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে নানা আলোচনার পর পতাকার নকশা, পরিমাপ নির্ধারণ করা হয়। ওইদিন রাতেই নিউমার্কেট থেকে কাপড় কিনে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কায়েদে আজম হলে (বর্তমান তিতুমীর হল) কাজী আরেফ অন্যদের নিয়ে জাতীয় পতাকার কাজ শুরু করেন এবং শেরেবাংলা হলে শিবনারায়ণ দাসের দক্ষ হাতে পরিসমাপ্তি হয়। পরে দরজির দোকান থেকে সেলাই করে প্রথমে হলে লুকিয়ে, পরে এক ছাত্রলীগ নেতার মালিবাগের বাসায় রাখা হয়।

তখনকার নকশা করা পতাকায় লাল বৃত্তের ভেতর বাংলাদেশের মানচিত্র ছিল। পরে অঙ্কনের সুবিধার্থে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি মানচিত্র সরিয়ে ফেলা হয় এবং ১৭ জানুয়ারি চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।

আয়তাকার সবুজ ক্ষেত্রের ওপর লাল বৃত্ত। আয়তাকার সবুজ ক্ষেত্র নির্দেশ করে বাংলাদেশের চিরতারুণ্য আর লাল বৃত্ত হলো আমাদের ঢেলে দেওয়া তাজা রক্ত। সবুজের মধ্যে ভেতর লাল বৃত্ত যেন প্রতিফলিত করে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা মনোরম এই পবিত্র ভূমির বাংলা মায়ের সন্তানদের তাজা রক্তের ফসল। আমাদের পতাকা আমাদের সাহস জোগায় দেশের জন্য লড়তে। দেশকে ভালোবাসতে। দেশের মাটি, মানুষকে ভালোবাসতে ১০: ৬ অনুপাতের এই পতাকা আমাদের প্রতিনিয়ত উদ্বুদ্ধ করে।

২০১৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির জাতীয় পতাকা বিশ্ব রেকর্ড গড়ে। শেরেবাংলা নগরে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ২ হাজার ৭১৭ জন মানুষ নিয়ে নির্মিত হয় মানব পতাকা। এটিকে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস সবচেয়ে বড় পতাকা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রতিটি সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া সাংবিধানিকভাবে জাতীয় পতাকার স্থান সুনির্দিষ্ট। জাতীয় দিবসগুলোতে সবাই পতাকাকে সম্মান করেন। রাষ্ট্রের প্রতীক হিসেবে জাতীয় পতাকা আমাদের কাছে মর্যাদার অধিকারী।

জাতীয় পতাকার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে এ দেশের ছাত্র-তরুণ ও আপামর বাঙালি দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। জাতীয় পতাকার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন আমাদের কর্তব্যের অংশ। দলমত– ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে আমরা সবাই জাতীয় পতাকাকে সমুন্নত রাখতে বদ্ধপরিকর।

মেজবা উদ্দিন
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ই–মেইল: [email protected]