পটিয়ার লবণ শিল্প: চানখালী খালের সেই জৌলুস হারালো কোথায়

পটিয়ায় চানখালী খালকে ঘিরে গড়ে ওঠে বিশাল লবণ শিল্প
ছবি: সংগৃহীত

‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।/ পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি,/ দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি’—চানখালী খালের পাড়ে গেলে কবি রবি ঠাকুরের কবিতাটি খুব মনে পড়ে। নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হই, মন পিছু ফিরে যায় নানাবাড়িতে কাটানো ছেলেবেলায়। আহা দুরন্ত কৈশোর! আহা শৈশব! কেউ কী ফিরিয়ে দেবে আমায়! কেঁ কোঁরত কেঁ কোরত দাঁড় টানার শব্দে চলত সাম্পান

পটিয়া শহরটি আসলে চানখালী খালের তীরে অবস্থিত। শহরের আশপাশ দিয়ে বয়ে গেছে আঁকাবাঁকা অনেক শাখা–উপশাখা খাল, বেশির ভাগ খালই এখন ভরাট হয়ে গেছে। অনেক ভূমিদস্যু দখলেও নিয়েছে। এ কারণে বর্ষা মৌসুমে পটিয়া শহর পানিতে টইটম্বুর হয়ে যায়।

পটিয়া সদরের ইন্দ্রপুলের মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা ধীরবহ গতিতে বয়ে চলেছে চানখালী খাল। পটিয়ার বিখ্যাত সুফি সাধক হজরত শাহচান্দ আউলিয়া (রহ.)-এর নামে নামকরণ চানখালী খালের। খালে শুভ্র ফেনা, ঘোলাটে পানি, নৌকা আর সাম্পানের কেঁ কোঁরত কেঁ কোঁরত দাঁড় টানার শব্দ, বাঁশের ভেলা সারিবদ্ধভাবে সাজানো। নৌকার মাঝিরা নৌকা থেকে কালো লবণের টুকরি মাথায় নিয়ে কূলের দিকে ফিরছেন। চাঁনখালী খালের এ দৃশ্য এখন অতীত। বাঁশের ভেলা, সাম্পান দেখা না গেলেও, কিন্তু লবণবোঝাই করা নৌকা নিয়মিত দেখা যায়।

চানখালী খালকে কেন্দ্র করে ইন্দ্রপুল এলাকায় লবণ শিল্প গড়ে ওঠে। ১৯৫২ সালের দিকে চানখালী খালের পাড়ে লবণশিল্পের সূচনা হয়। তখনকার দিনে ওই এলাকায় কোনো লবণ শিল্পকারখানা ছিল না। সে সময় সাম্পান বা বোটে করে বাঁশখালী এলাকা থেকে কালো লবণ এনে ইন্দ্রপুলে বিক্রি করা হতো। প্রথম দিকে এ শিল্পের সূচনা করেন হাজী চুন্নু মিয়া, পরবর্তী সময়ে চুন্নু মিয়ার ছেলে তোফায়েল আহমেদ সওদাগর (যিনি আমার মরহুম নানা) লবণশিল্পের প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।

পরবর্তী সময়ে আবদুল কাদের সওদাগর, আবদুর রহমান, নজু মিয়া, ফজর রহমান, আফাজুর রহমান, আবদুল খালেক, আবদুস ছামাদ, আবদুস সাত্তার, নুরুল হুদা, ইউসুফ, এজাহার মিয়া, মনীন্দ্রলাল, আবদুর রহিম, নজির আহমেদ, আলী আহমেদ, আজিজ সওদাগর, মতি সওদাগর, কবির আহমেদ, গাজী আবদুল কাদের, গাজী আবদুল হক, মুনসেফ আলী, আবুল খায়ের প্রমুখ এখানকার লবণশিল্প বিকাশে বড় ভূমিকা রাখেন। তাঁদের মধ্যে সবাই না ফেরার দেশে তাই পরবর্তী সময়ে হাল ধরেছে পরবর্তী প্রজন্মরা। ঢাকা খুলনার অনেক বড় ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরাও এখানে এসে বিনিয়োগ করছে।

লবণশিল্পের পাশাপাশি এখানে গড়ে উঠেছে চটশিল্প, সুতা, পলিব্যাগ, রাইস মিল, তুষ ও কালো কাঠের মিল, সেমাই ও ময়দা কারখানা। বর্তমানে ৪০-৪২টিরও বেশি লবণ শিল্পকারখানা রয়েছে। ছোটবেলায় দেখেছি এ খালের পাড়ে নৌকা তৈরি হতো। ১০ থেকে ১৫ হাজারেরও বেশি শ্রমিক এ শিল্প এলাকায় নিয়োজিত আছে। কক্সবাজার, চকরিয়া, বাঁশখালী, মগনামা, মহেশখালী, কুতুবদিয়া থেকে কালো লবণ এনে রিফাইনারির মাধ্যমে সাদা করা হয়। পরে সে লবণে আয়োডিন মিশ্রিত করে পলিব্যাগের মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়। লবণশিল্প এলাকায় প্রচুর পরিমাণে লবণের মাঠও রয়েছে। লবণের পানি আটকিয়ে রাখা হয়। প্রখর রোদ পড়লে দেখা যায় আটকিয়ে রাখা লবণের পানিগুলো শুকিয়ে লবণ উৎপাদিত হয়ে যায়। এ শিল্প গড়ে উঠেছে চানখালী খালকে কেন্দ্র করে।

মায়ের মুখে শুনেছিলাম সে সময় নাকি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এ চানখালী খালের খননকাজে সহযোগিতা করেন। কালের বিবর্তনে চানখালী খালের শাখা উপশাখা খালগুলো ভরাট হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে বাঁশশিল্প, খালের পানিতে বাঁশের ভেলা আর দেখা মিলে না। চানখালীর পাড়ে নৌকা ও সাম্পান তৈরির শিল্পও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পটিয়া লবণশিল্পের প্রাণ চানখালী খালসহ এর শাখা খালগুলো পুরোপুরি খনন করা জরুরি; নয়তো পটিয়ায় লবণশিল্প প্রসার লাভ করবে না। গ্রীষ্ম মৌসুমে চাষাবাদে পানির সংকটও দেখা যায়।

চানখালী খালে একসময় প্রচুর পরিমাণে চিংড়িসহ নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। খাল ভরাট ও পানি দূষিত হওয়ায় এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। তা ছাড়া বর্ষা মৌসুমে একটু বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। চানখালী খালসহ শাখা উপশাখা দখল হয়ে যাওয়া খালগুলো বিশেষ করে পটিয়া পৌরসভার এলাকার উত্তর গোবিন্দারখীল খাল, সূচক্রদণ্ডী খাল, পটিয়া কলেজের দক্ষিণ পাশসংলগ্ন খাল, হাবিবুর পাড়া খাল, টুইটে খাল, মির্জা বাড়ি ও খান বাড়িসংলগ্ন খাল, বনা খাল, সিও অফিসসংলগ্ন খালসহ প্রতিটি খাল পুনরুদ্ধার করে খনন করা অতীব জরুরি। নয়তো অদূর ভবিষ্যতে পটিয়া পৌরসভাসহ পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ পটিয়ার সম্মানিত জনপ্রতিনিধিদের সুদৃষ্টি কামনা করছি।

রশীদ এনাম
লেখক ও সংগঠক

পটিয়া, চট্টগ্রাম