পর্যটনকেন্দ্রে ফটোগ্রাফারদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনা হোক

সমুদ্র-পাহাড়-নদীসমৃদ্ধ এই দেশে আছে সব ধরনের পর্যটন আকর্ষণ। প্রায় প্রতিটি জেলাতেই রয়েছে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক ঘুরে বেড়ানোর জন্য প্রতিবছর ভিড় জমিয়ে থাকেন পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বরাবরই ভ্রমণকারীদের মুগ্ধ করে। এর মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ঐতিহাসিক মসজিদ ও মন্দির, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, পাহাড়, অরণ্য, বিস্তীর্ণ হাওর, চা–বাগান, এমনকি মেঘের রাজ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলার মতো চোখজুড়ানো স্থান রয়েছে।

২০২০ সালের মার্চ থেকে করোনা পরিস্থিতির কারণে মানুষ কোথাও বেড়াতে যেতে পারেনি। করোনা সংক্রমণ কমে যাওয়ায় খুলে দেওয়া হয়েছে পর্যটনকেন্দ্রগুলো। দীর্ঘদিন ভ্রমণে বের হতে না পারার অস্বস্তি কাটাতে পর্যটনকেন্দ্রে আসার জন্য মানুষ মুখিয়ে ছিলেন। সরকারের স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশনা মেনেই পর্যটকদের সেবা দিতে প্রস্তুত ছিল কর্তৃপক্ষ।

গত ডিসেম্বরে শীতের ছুটিতে তাই অনেকেই ছুটে যান তাঁদের পছন্দের জায়গাগুলোতে। পরিবার-পরিজন ও স্বজন কিংবা ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে বেড়াতে গিয়ে আনন্দের মুহূর্তগুলোকে ধরে রাখতে কে না চায়। আর তাই আনন্দঘন স্মৃতি ফ্রেমে বন্দী করতে অনেকেই মেতে ওঠেন ফটোসেশনে। পর্যটকদের এ চাহিদাকে পুঁজি করে পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে দিন দিন বাড়ছে ফটোগ্রাফারের সংখ্যা। পর্যটকদের ছবি তোলাকে কেন্দ্র করে হরহামেশা ঘটছে অপ্রীতিকর ঘটনা।

নানাভাবে আমরা জানতে পারি, ছিন্নমূল ও অনভিজ্ঞ কিছু কিশোর স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে ফটোগ্রাফি করছে। তাদের মধ্যে অনেকেরই ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতাও তো নেই বরং আদব-কায়দারও কোনো বালাই নেই। একজন পর্যটকের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে আচরণ করতে হয়, সেটাও তারা জানে না। আবার তাদের মধ্যে অনেকেই ফটোগ্রাফির আড়ালে পর্যটকদের মালামাল চুরির সঙ্গেও জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। অন্যদিকে না বলা সত্ত্বেও একাধিক ছবি তুলে পর্যটকদের কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায় করা তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে পর্যটকদের দেখে ফটোগ্রাফাররা ছুটে আসেন ছবি তুলে দেওয়ার জন্য। পর্যটক না করে দিলেও তাঁরা কিছু ছবি তুলে দেওয়ার জন্য জোর করতে থাকেন। প্রতিটি ছবির বিনিময়ে তাঁরা পাঁচ টাকাকে অনেক সামান্য বলে উপস্থাপন করেন। পর্যটকেরা ভাবেন, পাঁচ টাকাই তো, এ তেমন কিছুই নয়। এভাবেই পা দেন ফটোগ্রাফারদের ফাঁদে। ছবি তোলার সুযোগ পেয়ে একের পর এক ছবি তুলতে থাকেন ফটোগ্রাফার। ছবি তোলা শেষে যখন জানতে চাওয়া হয় ছবির সংখ্যা, সেই সংখ্যা শুনে যেন রীতিমতো চোখ কপালে উঠে যায় পর্যটকদের। আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টার ব্যবধানে তাঁরা তুলে ফেলেন ৫০০–৬০০ ছবি, যার মূল্য দাঁড়ায় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। ফটোগ্রাফাররা সব ছবি নেওয়ার জন্য পর্যটকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। পর্যটকেরা সব ছবি নিতে না চাইলে তাঁরা ধমক দেন। একই ছবি একাধিকবার থাকায় বেছে বেছে ছবি নিতে চাইলে ফটোগ্রাফাররা জুড়ে দেন আরেক শর্ত। বেছে বেছে ছবি নিলে প্রতিটি ছবির বিনিময়ে পরিশোধ করতে হবে দশ টাকা করে। এতে পর্যটক পড়েন আরেক ফাঁদে। ছবি বাছাই করল কি করল না, দু-চারটি ছবি ডিলিট করে তাঁরা তখন দাবি করেন তার থেকে আরও বেশি টাকা। পর্যটক এত টাকা দিতে রাজি না হলে তখন রীতিমতো তাঁদের সঙ্গে পর্যটকদের কথা-কাটাকাটি হয়। এই হলো বর্তমান পর্যটনকেন্দ্রগুলোর চিত্র।

ফটোগ্রাফারের এমন আচরণ প্রায়ই পর্যটকদের আনন্দ নষ্ট করে। তবে ঝামেলা এড়াতে এ ধরনের হয়রানির বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন না পর্যটকেরা। ফটোগ্রাফারের হাতে হয়রানির শিকারের অভিযোগ প্রায়ই এলেও কিছু ঘটনার তাৎক্ষণিক সমাধান হয়, অধিকাংশের কূলকিনারাই পাওয়া যায় না। হয়রানির ব্যাপারে কথা বলতে চাইলে অধিকাংশ ফটোগ্রাফার তা এড়িয়ে যান। এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে। ফটোগ্রাফারদের প্রতারণা এড়াতে পেশাদার ফটোগ্রাফারদের ডেটাবেইসের আওতায় আনতে হবে। আর কোনো পর্যটক হয়রানির শিকার হলে কর্তৃপক্ষের কাছে তৎক্ষণাৎ অভিযোগ করতে হবে। কেননা অভিযোগ না করে এড়িয়ে গেলে এ সমস্যার সমাধান হবে না। বরং আরও বৃদ্ধি পাবে। এর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর নজরদারি ও যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।

মো. আল-মামুন
শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা