পুরান ঢাকার জাঁকজমকপূর্ণ বড়দিন কোথায় হারাল

আর্মেনীয় গির্জা
ছবি: এএএফপি

ইংরেজ আমলে ঢাকার বড়দিনের উৎসবকে বিজ্ঞজনেরা দুর্গোৎসবের সঙ্গে তুলনা করতেন। তেমনি নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষও বলতেন, কলকাতার বড়দিনের উৎসব হিন্দুদের দুর্গোৎসবের চেয়ে কম নয়। এর থেকেই পুরান ঢাকা ও পুরোনো কলকাতার বড়দিনের উৎসব কত সাড়ম্বরে পালন করা হয়, তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

পুরান ঢাকায় বড়দিন আসার অনেক আগে থেকেই সাজ সাজ রব পড়ে যেত। সেই যুগে ঢাকার প্রতিটি সাহেববাড়িই রঙিন কাগজের মালা দিয়ে নয়নাভিরাম করা হতো। বাড়ির সব দেয়াল দেবদারুপাতা দিয়ে সাজানো হতো। ইউরোপীয় দোকান আর লক্ষ্মীবাজার-ওয়ারী-চকবাজারের দোকানদারেরাও আলোর মালা, কাগজের ফুল আর নকশা দিয়ে তাঁদের দোকান সাজিয়ে বড়দিনের আগমনী বার্তা ঘোষণা করতেন। এরপরই শুরু হতো বড়দিনের কেনাকাটা।

তখনকার পত্রপত্রিকায় এ প্রসঙ্গে আমরা দেখতে পাই— বর্গি হাঁকিয়ে দলে দলে ইংরেজ বিবিগণ দোকানে দোকানে ঘুরে পছন্দমাফিক উপহারসামগ্রী কেনাকাটা করিতেন। পুজোর বাজারের মতো বড়দিনের বাজারও ভিড়ে গমগম করিত।’ উপহার দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারে পুরান ঢাকার বড়দিনের উৎসবের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। বাড়ির পরিচারকেরা সাহেবদের কেক, কিশমিশ, ফলমূল, মাছ বা মাংস উপহার দিতেন। সেই উপহারকে বলা হয় ডালি। ডালির পাল্টা হিসেবে সাহেবরা পরিচারকদের পার্বণী দিতেন।

ব্রিটিশ শাসনামলে ঢাকার বড়দিনের উৎসব সবচেয়ে জমকালো হতো বিশেষ করে সাহেবদের প্রাসাদে। ঢাকায় বসবাসকারী ইংরেজ ও ব্রিটিশ সমাজের হোমরাচোমরা সাহেবরা চাঁদের মতো ঝকঝকে ও সালংকার মেমসাহেবদের নিয়ে বল নৃত্য করতেন। আলোকমালায় সজ্জিত সাহেবদের প্রাসাদ ঝলমল করত। সে যুগে ঢাকায় বড়দিনের আগের দিন রাত ১২টায় তোপ ছোড়া হতো। বেজে উঠত জাহাজের ভেঁপু। ক্রিসমাস ইভে ধর্মপ্রাণ খ্রিষ্টানেরা গির্জায় গির্জায় প্রার্থনা করতেন। এই উপাসনায় অন্য ধর্মাবলম্বীরাও যোগ দিতেন। এর পরদিনই শুরু হতো আসল উৎসব। এদিনে ঢাকার বাবুসমাজ বড়দিন কাটাতেন পানীয় গ্রহণ করে আর বাইজিদের নাচ উপভোগ করে।

সাধারণ মানুষ বড়দিন কাটাতেন মার্কেট থেকে কেক, কিশমিশ, কমলালেবু কিনে কিংবা সার্কাস অথবা যাত্রার আসরে ভিড় জমিয়ে। এককথায়, ব্রিটিশ শাসনামলে ঢাকার বড়দিনের উৎসব ছিল আনন্দ থেকে মহানন্দের, ভোগ থেকে ত্যাগের, বিনোদন থেকে আত্মনিবেদনের; যার পরতে পরতে মিশে থাকত প্রভু যিশুর মানবকল্যাণের মহার্ঘ মুহূর্ত। আবার অনেক সাহেব বড়দিনের উপাসনা করে পরিবারের সঙ্গে কাটাতেন। তাঁদের কাছে বড়দিন নাচ, গান ও আমোদ-প্রমোদের জন্য ছিল না।

২৫ ডিসেম্বর বড়দিন বা ক্রিসমাস ডে হচ্ছে বাৎসরিক খ্রিষ্টীয় ধর্মানুষ্ঠান বা উৎসব। যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন উপলক্ষে এ উৎসব উদ্‌যাপিত হয়। যিশু যেহেতু বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য ধর্ম ও দর্শন দিয়ে গেছেন, বিশ্বব্যাপী বিশাল অংশের মানুষ তাঁর দেওয়া ধর্ম ও দর্শনের অনুসারী। অনেকে দিনটিকে ঐতিহাসিক রোমান উৎসব বলে মনে করেন। কোনো কোনো দেশে, বিশেষ করে উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আয়ারল্যান্ডে ফাদার ক্রিসমাস বা সান্তা ক্লজ কর্তৃক ছোটদের জন্য বড়দিনের উপহার আনার উপকথাটি বেশ জনপ্রিয়।

বড়দিনের ছুটির কেন্দ্রীয় দিন এবং খ্রিষ্টধর্মে ১২ দিনব্যাপী খ্রিষ্টমাসটাইড অনুষ্ঠানের সূচনা দিবস। বড়দিনে যা যা করা হয়—গির্জায় গির্জায় উপাসনা, উপহার প্রদান, পারিবারিক সম্মেলন, গৃহসজ্জা ইত্যাদি কত কী! আমি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, তখন গোমেজ ছিল আমার ক্লাসমেট। বড়দিনের উৎসবে গোমেজের বাড়িতে কয়েকবার গেছি। দেখেছি, ওই দিনে তাদের বাড়িতে আলোকসজ্জা, টেবিলে সাজানো হরেক রকমের খাবার। উৎসবের আগের দিন আমার হাতে বড়দিনের কার্ড দিয়েছিল। কার্ডটি এতই সুন্দর ছিল যে আবেগে বারবার কার্ডে চুমু খেয়েছি। আহা, কোথায় গেল সেই বড়দিনের উৎসব! আশপাশে এখন আর দেখি না কোনো খ্রিষ্টান বন্ধু। ব্রিটিশ আমল শেষ হলো, পাকিস্তান আমলেরও অবসান ঘটল, সেসব খ্রিষ্টান বন্ধুও কোথায় যেন হারিয়ে গেল! বড় বড় গির্জায় আজকাল সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে ধর্মোপাসনা, ভোজ, বড়দিনের বৃক্ষ, আলোকসজ্জায়। জাঁকজমকপূর্ণ বড়দিন আর দেখি না। পুরোনো স্মৃতিগুলো মনে পড়ে।

লিয়াকত হোসেন
রূপনগর, ঢাকা