প্রথম আলোর একটি কপি কিনতে ৪০০ টাকা খরচ করেছিলাম

১৯৯৮ সালে ৪ নভেম্বর প্রকাশিত হয় প্রথম আলোর প্রথম সংখ্যা

তখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। মতিউর রহমান সম্পাদিত ভোরের কাগজ পাঠকপ্রিয় পত্রিকা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক আবদুল মান্নান ও মমতাজ উদ্দীন পাটোয়ারী নিয়মিত কলাম লিখতেন ভোরের কাগজে। শিক্ষক পরিচয় ছাপিয়ে কলাম লেখক হিসেবে তাঁরা ক্যাম্পাসে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। একসময় আমরা কয়েকজন—সোনালী চাকমা, পার্থ সনজয়, ফরিহানা পপি, আমি—লিখতে শুরু করি পাঠকপাতা আর চিঠিপত্র বিভাগে। কী কাণ্ড, শুধু ভোরের কাগজে অল্পস্বল্প ফিচার আর চিঠি লিখেই আমরাও পরিচিতি আর জনপ্রিয়তা পেয়ে যাই ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে সারা দেশে!

কিন্তু একদিন আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, যখন শুনলাম ভোরের কাগজ ছেড়ে মতিউর রহমান চলে যাচ্ছেন। আমাদের মনখারাপের কাল অবশ্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। খবর পেলাম, নতুন পত্রিকা আসছে—প্রথম আলো। সম্পাদক মতিউর রহমান।

পাঠকপাতায় লিখে আমরা শুধু পাঠকদের কাছেই পরিচিতি পাইনি, আমাদের মনে রেখেছেন সম্পাদক আর বিভাগীয় সম্পাদকেরাও। নতুন পত্রিকার বার্তা আর সঙ্গে থাকার আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁরা আমাদের কাছে চিঠি পাঠান। আমরা নড়েচড়ে বসি। প্রথম আলোর আগমনবার্তা আমরা পৌঁছে দিই পাঠকদের কাছে। পাঠকসংগঠন বন্ধুসভা গঠনের জন্য প্রচারণা চালাতে থাকি। প্রথম আলোই একমাত্র পত্রিকা, যেটা প্রকাশের আগেই তার পাঠকসংগঠন দাঁড়িয়ে যায়।

এরপর অপেক্ষার পালা। ৪ নভেম্বর ১৯৯৮। বেলা দুইটার দিকে হকার আসেন পত্রিকা নিয়ে। কিন্তু এ কী, প্রথম আলো নেই! হকার বললেন, অর্ধেক পাঠককেও প্রথম আলো দেওয়া যায়নি। এত এত চাহিদার বিষয়টা তাঁরা আঁচ করতে পারেননি। হতাশায় আমাদের মাথার চুল ছেঁড়ার অবস্থা। হকার আমার কানে কানে বললেন, আপনারা এখন চলে যান। আমি কয়েক কপি লুকিয়ে রেখেছি। পরে আপনাদের রুমে পৌঁছে দেব।

বিকেলের দিকে হাতে পাই প্রথম আলোর প্রথম সংখ্যাটি। হাতে নিয়েই ভেবেছি, এই পত্রিকাই আমাদের জীবনের আবশ্যিক অনুষঙ্গ হয়ে উঠবে। হয়েছেও তা-ই। প্রথম আলো ছাড়া আমাদের দিনযাপনের কথা ভাবতেও পারি না।

এই ভাবতে না পারার মধ্যেও একটু বাড়াবাড়ি আছে বোধ হয়। আমার বাড়াবাড়িটা আরও এক কাঠি বেশি। তখন অনলাইন সংস্করণ ছিল না। কী কারণে যেন আমাদের এলাকায় একদিন প্রথম আলো আসেনি। আশপাশে অনেক খুঁজেও সেদিনের কপিটা পেলাম না। পরদিন নোয়াখালী থেকে আমি চলে গেলাম ঢাকায়। প্রথম আলো অফিসে গিয়ে কপিটা সংগ্রহ করলাম। সাত টাকার পত্রিকা কেনার জন্য আমি ৪০০ টাকা ভাড়া গুনেছি। এ ঘটনার কথা আমি কাউকে বলতেও পারিনি এই ভেবে যে পাছে লোকে আমাকে পাগল ভেবে বসে!

কিন্তু কেন এই পাগলামি? কী আছে প্রথম আলোয়?
প্রথমত বিশ্বাসযোগ্যতা, দ্বিতীয়ত রুচিবোধ, তৃতীয়ত সৃজনশীলতা।
বিশ্বাসযোগ্যতার একটা গল্প বলি শুধু। ২০০০ সালের ৫ মে। একটা ভীতিকর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। শুক্রবার ছিল। খবর ছিল, বেলা ২টা ১২ মিনিটে মহাজাগতিক কারণে গ্রহ-নক্ষত্রগুলো একই সরলরেখায় চলে আসবে। গড়বড় লেগে যাবে মহাকর্ষবলে। ফলাফল, মহাপ্রলয়। তখন অনলাইন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল না। তবু আতঙ্ক ছড়িয়েছে দ্রুত। খবরের কাগজগুলো যোগ দিয়েছিল তাতে। ভয়ে আমাদের গলা শুকিয়ে মরে যাওয়ার জোগাড়। আর তখনই প্রথম আলো আমাদের আশ্বস্ত করে। নাসা আর জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের উদ্ধৃতি দিয়ে লাল কালিতে প্রধান শিরোনাম করে তারা। খবর পড়ে আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। আমাদের প্রাণস্পন্দন স্বাভাবিক হয়।

আর রুচিবোধ? প্রথম আলো বোঝে শিশু থেকে বৃদ্ধ—সবার মনস্তত্ত্ব। আর তাই শনি থেকে শুক্র—প্রতিদিনের পত্রিকা তারা এমনভাবে সাজায়, দাদা আর নাতি একসঙ্গে বসে পড়তেও কোনো সমস্যা হয় না। এই রুচিবোধের কারণেই প্রথম আলো হয়ে উঠেছে সম্পূর্ণ পারিবারিক পত্রিকা।

প্রমিত বাংলা বানানের ক্ষেত্রে প্রথম আলোর ভূমিকা যুগান্তকারী। বাংলা একাডেমির অভিধান সবার হাতে থাকে না, কিন্তু প্রথম আলো থাকে হাতে হাতে। প্রমিত বানান দেখা ও শেখার ক্ষেত্রে প্রথম আলো তাই আমাদের প্রধান ভরসা। প্রথম আলোর সৌজন্যে আমরা কিছু নতুন বাংলা শব্দ পেয়েছি। যেমন: পদচারী–সেতু, উড়ালসড়ক, জলকপাট।

সৃজনশীলতায় প্রথম আলো নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে, যেখানে পৌঁছার সক্ষমতা আর কোনো পত্রিকা এখন পর্যন্ত দেখাতে পারেনি। বরং প্রথম আলোকে অনুকরণ করার এক বালখিল্যপ্রবণতা আছে অন্য পত্রিকাগুলোর মধ্যে।

সংবাদ পরিবেশনা, পৃষ্ঠাসজ্জা—কোথায় নেই সৃজনশীলতা? নাইন–ইলেভেনের পরদিন প্রথম আলো আট কলামজুড়ে শিরোনাম করেছিল—‘অবিশ্বাস্য এক যুদ্ধ!’। বাংলাদেশ প্রথম যেদিন অস্ট্রেলিয়াকে হারায়, তার পরদিন প্রথম আলো লিখেছে—‘বাঘের গর্জন শুনেছে বিশ্ব’। কিংবা সাম্প্রতিক শিরোনাম, ‘উনিশের হাত ধরে বিশে বিশ্বজয়’। এমন মনকাড়া শিরোনাম আর কে কখন করতে পেরেছে?

প্রথম আলো তাই অনন্য। প্রথম আলো আমাদের মন এতটাই দখল করে নিয়েছে যে এর কলাকুশলীদেরও কেমন যেন আপন আপন মনে হয়। সম্পাদক মতিউর রহমান যেমন আমাদের আপনজন, তেমনি আপনজন সাতকানিয়া প্রতিনিধি মামুন মুহাম্মদ কিংবা রংপুর প্রতিনিধি আরিফুল হক।

শেষে একটা অপ্রাপ্তির কথা বলি। আমি থাকি চট্টগ্রামে। ভোরেই পত্রিকা পাই। কিন্তু চট্টগ্রাম সংস্করণে অন্য আঞ্চলিক খবরগুলো তেমন একটা পাই না। আবার চট্টগ্রামের খবর অন্য অঞ্চলের পাঠকদের কাছে যায় না। এটা কেন? আমি কেন রাজধানী ঢাকা কিংবা বগুড়া জেলার সব খবর পড়া থেকে বঞ্চিত হব? প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ আমার এই অনুযোগের বিষয়টা আশা করি ভেবে দেখবে।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য এই লেখার অবতারণা। সময়ের হিসাবে ২২ বছর পার করল প্রথম আলো। কিন্তু আমাদের মতো পাঠকদের মননে প্রথম আলোর বসবাস যেন জনম জনম। শুভকামনা প্রথম আলোর জন্য।

মাইনুল এইচ সিরাজী শিক্ষক ও লেখক, চট্টগ্রাম।
[email protected]