ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যই ওজোনস্তর রক্ষা করা জরুরি

গত বৃহস্পতিবার পালিত হলো আন্তর্জাতিক ওজোনস্তর সুরক্ষা দিবস বা বিশ্ব ওজোন দিবস। ওজোনস্তরের ক্ষয় ও এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা তৈরিতে প্রতিবছর ১৬ সেপ্টেম্বর দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে পালন করা হয়। তবে ওজোনস্তর কী এবং এর কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে আমরা অনেকেই ভালোভাবে অবগত নই। এ বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি।

ওজোনস্তর (ওজোন লেয়ার) হচ্ছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের একটি স্তর, যেখানে তুলনামূলকভাবে বেশি মাত্রায় ওজোন গ্যাস থাকে। এই স্তর থাকে প্রধানত স্ট্র্যাটোমণ্ডলের নিচের অংশে, যা ভূপৃষ্ঠ থেকে কমবেশি ২০-৩০ কিলোমিটার ওপরে অবস্থিত। বায়ুমণ্ডলের এ স্তরে তুলনামূলকভাবে বেশি মাত্রায় ওজোন গ্যাস থাকে। ওজোনস্তরে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির সাহায্যে আণবিক অক্সিজেন ও পারমাণবিক অক্সিজেনের মধ্যে গলন বা ফিউশনের কারণে ওজোন গ্যাস তৈরি হয়। ফরাসি পদার্থবিদ চার্লস ফ্যাব্রি ও হেনরি বুইসন ১৯৩০ সালে ওজোনস্তর আবিষ্কার করেন।
১৯৮২ সালের অক্টোবরে এক দল বিজ্ঞানী অ্যান্টার্কটিকার আকাশে লক্ষ করেন, বৃহৎ অংশজুড়ে ওজোনস্তরের ঘনত্ব অত্যন্ত কম হয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, ওই অঞ্চলের ওজোনস্তরে একটি গহ্বর সৃষ্টি হয়েছে। এই স্তরের পুরুত্ব স্থানভেদে ও মৌসুমভেদে কমবেশি হয়। বিজ্ঞানী ফারমেন ওজোনস্তরের এই অবক্ষয়কে ওজোন হোল নামে চিহ্নিত করেন।

ওজোনস্তরের ক্ষয়ের কিছু কারণ রয়েছে। সেগুলো হলো:
১. ওজোন গ্যাসের রং নীল। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির উপস্থিতিতে একটি ওজোন কণার সঙ্গে একটি অক্সিজেন পরমাণুর আলোক–রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে ওজোন ধ্বংস হয়। এই বিক্রিয়ায় ওজোন কণাটি অক্সিজেন অণুতে পরিণত হয়।
২. গৃহস্থালি পণ্য ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনারসহ বিভিন্ন ধরনের স্প্রে ইত্যাদিতে ব্যবহৃত ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (সিএফসি) গ্যাস ওজোনস্তরের ক্ষয়ের অন্যতম কারণ। মানুষের দ্বারা বায়ুমণ্ডলে যুক্ত যৌগ ক্লোরোফ্লোরো কার্বনগুলো রেফ্রিজারেন্ট হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। যৌগগুলো ওজোনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ওজোনস্তরের ক্ষতি করে।
৩. শিল্পাঞ্চলে কারখানার চিমনি থেকে নির্গত ভাসমান সালফেট অ্যারোসল ওজোন অণুকে বিয়োজিত করে অক্সিজেন অণু ও পরমাণুতে রূপান্তর করে।

বর্তমানে মানুষের আয়ু বাড়লেও অল্প বয়সে মানুষ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যদি ওজোনস্তরের মাত্রাতিরিক্ত ক্ষয় হতে শুরু করে, তাহলে জীবজগতের জন্য ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে চলে আসবে। এটি সমগ্র জীবজগতের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এর প্রভাবে প্রাণীদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাবে, চোখের ছানি, ত্বকের ক্যানসারসহ নতুন নতুন রোগের উদ্ভব ঘটবে। ধারণা করা হচ্ছে, ওজোনস্তরের ক্ষয়ের কারণে সারা বিশ্বে পাঁচ লাখ লোক স্কিন ক্যানসারে ভুগবে।

একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ১ শতাংশ অতিবেগুনি রশ্মি বৃদ্ধির প্রভাবে সাদা চামড়ার মানুষের মধ্যে নন–মেলোনোমা ত্বকের ক্যানসার বৃদ্ধি পাবে চার গুণ। প্রাণিজগতের অনেক প্রজাতির গড় আয়ু হ্রাস পাবে। উভচর প্রাণীর সংখ্যা দ্রুত কমবে। অতিবেগুনি রশ্মি খাদ্যশস্যের ক্ষতি করবে, বৃক্ষাদি ও অরণ্যের পরিমাণ ক্রমেই হ্রাস পাবে। উদ্ভিদের পাতাগুলো আকারে ছোট ও হলুদ হয়ে যাবে, অর্থাৎ ক্লোরোসিস রোগ হবে। বীজের উৎকর্ষ নষ্ট হবে। ফসলে আগাছা, রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ বৃদ্ধি পাবে। উদ্ভিদের অকালমৃত্যু বৃদ্ধি পাবে, উৎপাদনশীলতা ও স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাস পাবে। প্রাকৃতিক খাদ্যচক্রের ক্ষতি সাধিত হবে, এতে জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হবে। তথ্যমতে, পৃথিবীতে এক-পঞ্চমাংশ অন্ধত্বের রোগী ও ৯০ শতাংশ ক্যানসারের জন্য দায়ী অতিবেগুনি রশ্মি। এই রশ্মির প্রভাবেই শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সন্তানের জন্ম হয়ে থাকে।

উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের সবারই রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাস করতে ওজোনস্তরের ক্ষয় কমবেশি ভূমিকা রাখছে। ক্লোরোফ্লোরো কার্বন প্রধানত আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় শীতাতপনিয়ন্ত্রণের যন্ত্রপাতি, যেমন রেফ্রিজারেটর, অ্যারোসল, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, কম্পিউটার ও অন্যান্য যন্ত্রের সার্কিটে পরিষ্কারক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পৃথিবীর প্রায় ৬০ ভাগ কার্বন নিঃসরণ করে থাকে আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, ভারত, জার্মানি ও যুক্তরাজ্য। ওজোনস্তর রক্ষায় এসব দেশকে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে বিকল্প জ্বালানির সন্ধান করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির প্রয়োগ কমিয়ে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, পানিশক্তির মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে।

পৃথিবীর সর্বত্রই এখন প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে চলেছে। দৃশ্যমান হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। তাই আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর ও বাসযোগ্য সবুজ পৃথিবী রেখে যেতে হলে ওজোনস্তর রক্ষায় শিল্পোন্নত দেশগুলোকে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। এ ব্যাপারে পৃথিবীর সব স্কুল–কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওজোনস্তর রক্ষায় ও সামগ্রিক পরিবেশ সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

মাহমুদা রহমান
শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।