রেমিট্যান্স–যোদ্ধাদের দুর্ভোগ ঘুচবে কবে?

বাংলাদেশের উন্নতি ও অগ্রগতির প্রধান সোপান রেমিট্যান্স। দেশের বাইরে গতর খেটে লাল-সবুজের পতাকা সমৃদ্ধি বৃদ্ধির জোগান দিয়ে আসছেন প্রবাসী শ্রমিকেরা। প্রবাসীদের কষ্টার্জিত রেমিট্যান্সে গড়ে ওঠা স্তম্ভে মজবুত হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত। দেশের বর্তমান জিডিপিতে প্রায় ১২ শতাংশ অবদান রেখে চলা রেমিট্যান্স হয়ে উঠেছে দেশের উন্নয়ন ও মুদ্রার রিজার্ভ স্ফীতির উল্লেখযোগ্য অংশীদার।

বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, করোনাকালীন প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে সদ্য সমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবাসীরা ১ হাজার ৮২০ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১ লাখ ৫৪ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে), যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একক বছরে আহরিত সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স। এমনকি চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রবাসীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৬৭১ কোটি ৩০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৬৭ হাজার ৬০ কোটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ফলে সেপ্টেম্বর মাস শেষে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩৯ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। ওয়েব আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৬-৭ লাখ মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন। এই প্রবাসীরা প্রতিবছর প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠান। বাংলাদেশি হিসাবমতে, ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের অর্ধেকের বেশি। এত বিপুলসংখ্যক মানুষ দিন–রাত পরিশ্রম করে শুধু দেশের মুদ্রার রিজার্ভ স্ফীতিতে অবদান ও পরিবারের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থাই করেননি বরং জীবনযাত্রার মান, কর্মসংস্থান, কাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা, চিকিৎসা ও ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাতে রেখে আসছেন অভাবনীয় অবদান।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে ১৭৪টি দেশে বাংলাদেশ শ্রমিক প্রেরণ করে আসছে, যা প্রায় ১ কোটি ২০ লাখের বেশি। যাঁদের তিন-চতুর্থাংশ নিয়োজিত রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, রেমিট্যান্স আয়ের তিন ভাগের দুই ভাগই আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী জালানি তেলের দরপতন, ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটনশিল্পে ধস ও রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা প্রতিকূলতায় সংকটে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। যে কারণে কর্মী ছাঁটাই ও বেতন বন্ধসহ বহুবিধ সমস্যার শিকার হচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত রেমিট্যান্স–যোদ্ধারা। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হিসাবমতে, বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ, করোনার কারণে কাজ না থাকা, চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া, প্রতারিত হওয়া ও ভিসার মেয়াদ কিংবা আকামার মেয়াদ না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে গত পয়লা এপ্রিল থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত সোয়া দুই লাখের বেশি কর্মী দেশে ফিরেছেন। তার মধ্যে সৌদি ও আরব আমিরাত থেকে দেশে ফিরযেছেন ১ লাখ ২০ হাজার ৮৮৯ জন, যা মোট দেশে ফেরার ৫৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো বৈদেশিক শ্রমবাজারেও যে বেশ বড়সড় ধাক্কা লেগেছে তা সহজেই অনুমেয়। বলতে গেলে গত এপ্রিল মাস থেকে নতুন করে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ থাকায় এবং দেশে-বিদেশে প্রবাসীরা আটকে পড়া ও সব পুঁজি নিয়ে দেশে স্থায়ীভাবে ফিরে আসার কারণে একদিকে প্রবাসীদের সামনের দিনগুলো যেমন কঠিন হবে, অন্যদিকে রেমিট্যান্সের ধারাও থাকবে নিম্নমুখী, দেশীয় অর্থনীতিতে যার রেশ খুবই ভয়াবহ হতে পারে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। সম্প্রতি ভিসা পেয়েও করোনার কারণে সৌদি আরব যেতে না পারা প্রায় পৌনে এক লাখ কর্মীর ওপর নিত্যনতুন শর্ত চাপাচ্ছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। প্রথমে কর্মীদের ফের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে বহির্গমন, পুলিশের ছাড়পত্রসহ নতুন ভিসার আবেদনের শর্ত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নতুন করে সৌদি কর্তৃপক্ষ ফের যুক্ত করেছে ওকালা নিতে হবে এবং কর্মী পাঠানোর দায়িত্বে থাকা রিক্রুটিং এজেন্সির মালিককে স্নাতক পাস হতে হবে। এসব শর্তের কারণে অনেক কর্মীর সৌদি যাওয়া হবে না। গেলেও সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজারের মতো আর্থিক খরচা হবে। কিন্তু করোনাকালে নতুন করে অর্থ খরচা করার অবস্থায় নেই কর্মীরা। তা ছাড়া যুগ যুগ ধরে উচ্চশিক্ষিত নয় এমন রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী পাঠাচ্ছে, হঠাৎ করে স্নাতক পাসের সনদই বা কোথায় পাবেন তাঁরা? সব মিলিয়ে বিদেশে যাওয়া নিয়ে বিপাকে পড়ছেন কর্মীরা। শুধু নতুন কর্মী নয়, সৌদি থেকে ফিরে আসা দেশে আটকে পড়া অনেক শ্রমিকই শর্তের বেড়াজালে আটকে পড়েছেন।

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ রেমিট্যান্স–যোদ্ধারা। দেশের অর্থনীতিকে সজীব ও জাগ্রত রাখতে এবং প্রবাসীদের অবদানের কথা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করে সরকারের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই নতুন কর্মী নিয়োগে যেসব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে, তা রোধে দ্রুত কার্যকারী পদক্ষেপ নিতে হবে। এটিকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশ থেকে জোরপূর্বক শ্রমিক ফেরত পাঠানো আটকাতে এবং ফেরত আসা শ্রমিকদের পুনরায় অভিবাসনের জন্য সরকারকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা ছাড়া বিকল্প পথ এখন খোলা নেই। প্রয়োজনে নতুন শ্রমবাজার খোঁজার পাশাপাশি গন্তব্য দেশগুলোর সঙ্গে দর–কষাকষি করে প্রবাসীদের শ্রমবাজার নিশ্চিত করতে হবে। ইতিমধ্যে দেশে ফিরে আসা প্রবাসীদের অনেকে দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গেছেন। যেসব পরিবার প্রবাসীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে দিনানিপাত করত, সেসব পরিবারের অধিকাংশই আজ মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এদিকে সামনে শীতে করোনার সেকেন্ড ওয়েবের কারণে মহামারি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। তখন বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক কর্মী ছাঁটাই হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে নতুন করে দেশে ফেরা এবং দেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের সব মিলিয়ে সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে।

অবশ্য জনবান্ধব বাংলাদেশ সরকার প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণার্থে বেশ দৃঢ় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। দেশে ফিরে আসা প্রবাসীদের ৪ শতাংশ হারে ২০০ কোটি টাকা প্রণোদনা ঋণদানসহ ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা হলে এবং দেশে ফিরে আসা রেমিট্যান্স–যোদ্ধাদের সরকারি সহায়তার পাশাপাশি বেসরকারিভাবে আর্থিক ঋণ দিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা হলে সে ক্ষেত্রে প্রবাসীদের দুর্দশার মাত্রা কিছুটা লাঘব হতে পারে। তা ছাড়া রিক্রুটিং এজেন্সির দায়িত্বহীনতা বা অবৈধভাবে বিদেশে শ্রমিক প্রেরণের কারণে প্রবাসীরা চুক্তিতে উল্লিখিত মজুরি, কর্মঘণ্টা বা উপযুক্ত কর্মপরিবেশ থেকে বঞ্চিতসহ নানা হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। সুতারাং বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সিজনিত নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে এবং এখানে সুশাসনের শর্ত নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার পর বৈদেশিক শ্রমবাজারে দক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তি ব্যতীত মূল্যায়ন হবে না। তাই দেশে ফিরে আসা শ্রমিকদের পুনরায় কর্মস্থলে প্রেরণ ও নতুন জনশক্তি রপ্তানির লক্ষ্যে বৈদশিক শ্রমবাজারের পরিবর্তিত চাহিদানুযায়ী কর্মদক্ষতাসম্পন্নরূপে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণের জন্য কারিগরি সহায়তা সরবরাহে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তরিক উদ্যোগ জরুরি।

রেমিট্যান্স–যোদ্ধারা আমাদের দেশের মহামূল্যবান সম্পদ। দেশের উন্নয়নে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির প্রয়োজন, নতুবা দেশের উন্নয়ন বিরাটকায় বাধাগ্রস্ত হবে। সুতরাং রেমিট্যান্স–যোদ্ধাদের দুর্দশা লাঘব ও স্বার্থ সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখবেন বলে সরকারের প্রতি প্রত্যাশা দেশবাসীর।

মোহম্মদ শাহিন

শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]