শাটল ট্রেনের উচ্ছল দিনগুলো কোথায় হারাল?

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেন
ছবি: প্রথম আলো

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত আয়তনে দেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে দৃষ্টিনন্দন সবুজ প্রকৃতি আর নয়নাভিরাম ছোট-বড় পাহাড়সারিকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই ক্যাম্পাসে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী শাটল ট্রেনে করে যাতায়াত করে। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য যেখানে রয়েছে বাস, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র যেন তার সম্পূর্ণই বিপরীত। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের যাতায়াতকে দ্রুততর, স্বাচ্ছন্দ্যময় ও আনন্দমুখর করে তুলতেই ১৯৮০ সালে একমাত্র বাহন হিসেবে যাত্রা শুরু করে গৌরবময় সংস্কৃতি ও ক্যাম্পাসের প্রাণভোমরা এই শাটল ট্রেন। বর্তমানে ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহের পাঁচ দিন এক জোড়া শাটল ট্রেন পালাক্রমে চট্টগ্রাম শহরের বটতলী রেলস্টেশন থেকে ক্যাম্পাস এবং ক্যাম্পাস থেকে বটতলী রেলস্টেশনে সাতবার করে যাওয়া-আসা করে। আর এর মাধ্যমে শাটল দুটি প্রায় ১০ হাজারের অধিক শিক্ষার্থীকে প্রদান করে আসছে যাতায়াতের সুবিধা।

শাটল ট্রেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ, প্রতিটি শিক্ষার্থীর মিলনমেলার প্রাণকেন্দ্র। ট্রেনের প্রতিটি বগি, সিট ও পাটাতন শিক্ষার্থীদের গল্প-আড্ডা, খুনসুটি আর বন্ধুত্বের বেড়াজালে গানের প্রাণরসে পরিপূর্ণ আসর জমানোর প্রধান বাদ্যযন্ত্র। প্রতিদিন ক্লাস শেষে ক্লান্তির ঝাপসা গুমোট আবহকে পশ্চাতে ফেলে প্রত্যেক শিক্ষার্থীই আপন মনে গলা মেলায় সুরের মূর্ছনায়। অগ্রজ-অনুজ সম্পর্কের দূরত্ব ভুলে সৃষ্টি করে প্রাণবন্ত রেশ, উচ্ছ্বসিত আনন্দঘন পরিবেশ। একসময় শাটলের প্রতিটি বগি পরিচিত ছিল বগিভিত্তিক সংগঠন যেমন ককপিট, অক্টোপাস, একাকার, সিএফসি, এপিটাফ, বিজয়, অলওয়েজ, সিক্সটি নাইন, ফাইট ক্লাব, উল্কা ও ভার্সিটি এক্সপ্রেস, সাম্পান ইত্যাদি নান্দনিক নামে। বগিভিত্তিক সংগঠনগুলোর বদৌলতে পুরো বছরই শাটলে বিরাজ করত উৎসবমুখর পরিবেশ। শিল্পীর রংতুলির আঁচড়ের আকিঁবুকিঁতে সৃষ্টি হতো বিচিত্র সব শৈল্পিক কর্ম। দৃষ্টিনন্দন এসব চিত্রকর্মের অনন্য কারুকাজ শোভা পেত শাটলের প্রতিটি বগিতে।

তবে সময়ের প্রবাহে শাটলের সেই পুরোনো ঐতিহ্য যেন আজ মলিন হয়ে উঠেছে। হারিয়ে যেতে বসেছে শিক্ষার্থীদের আনন্দোচ্ছ্বাস। সাম্প্রতিক সময়ের নানাবিধ অনিয়ম আর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাপ্রবাহই যেন জানান দিচ্ছে এ কথা! সময়ের সংকীর্ণতায় কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে বহু বছর। বেড়েছে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা। তার সঙ্গে বেড়েছে প্রতিযোগিতাপূর্ণ ভিড়। বাড়েনি শাটলের সিট কিংবা বগির সংখ্যা। এর ফলে প্রতিদিনের যাতায়াতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সিট দখলের জন্য নামতে হয় তীব্র প্রতিযোগিতায়। বই-খাতা, ব্যাগ-ছাতা, পানির বোতল, পত্রিকার পাতা এমনকি ছোট-বড় নুড়িপাথর দিয়েও সিট দখলের দৃশ্য চোখে পড়ে। নিয়ম মেনে নির্দিষ্ট সময়ে বন্ধুদের মধ্য থেকে পর্যায়ক্রমে কোনো একজন সিট ধরবে এবং বাকিরা ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগমুহূর্তে সদলবলে বুক ফুলিয়ে হাজির হবে, এমনটাই বর্তমান শাটলের নিত্যদিনকার স্থিরচিত্র। এমনকি, সিটের দখল অটুট রাখতে মাঝেমধ্যেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হয় ছোটখাটো বাগ্‌বিতণ্ডার; কালেভদ্রে তা গড়ায় তুমুল ঝগড়ায়! কখনো কখনো সেখান থেকেই সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক কোন্দলের এবং পরিস্থিতি আবর্তিত হয় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায়!

২০১৫ সালে বগিভিত্তিক সংগঠনের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই এই দুরবস্থা। এখন আর শাটলে দল বেঁধে কেউ গান করে না। বগির শোভা বৃদ্ধিকারী আলপনাগুলোও এখন আর চোখে পড়ে না। এর ফলে বর্তমান শাটলে ভ্রমণ যেন ক্লান্তিকর, গানের রেশবিহীন একধরনের নীরব নিস্তব্ধতা। ক্যাম্পাসের সাম্প্রতিক ছাত্ররাজনীতির হালচালও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে ভয়ভীতি। পান থেকে চুন খসলেই ক্ষমতাসীন ছাত্র–সংগঠনের একাধিক গ্রুপের ভেতরে শুরু হয় দফায় দফায় পাল্টাধাওয়া। আর এর বিরূপ প্রভাব শাটলেও বিস্তার করছে সমানভাবে।

এ ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বাহনে স্থানীয় বাসিন্দাদের দৌরাত্ম্যও যেন বেড়ে গেছে। গ্রাম থেকে শহরে যাতায়াতের জন্য তাঁরা বেছে নিয়েছেন বিনা মূল্যে যাতায়াতের এ বাহনকে। এমনকি, কখনো কখনো হালকা থেকে ভারী মালামাল নিয়েও শাটলে উঠছেন তাঁরা। আর এতেও ঘটছে বিপত্তি। ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে না নিজেদের জন্য বরাদ্দ করা সিট, শুরু হচ্ছে বাগ্‌বিতণ্ডা। কখনো দাঁড়িয়ে তো কখনো বাদুড়ঝোলা হয়ে পৌঁছাতে হচ্ছে গন্তব্যে। ছাত্রীদের জন্য বিষয়টি অনেকটা অস্বস্তিকর। এমনকি, চলন্ত এই বাহনে বেড়ে গেছে ছিনতাইকারীদের অপকর্ম। ট্রেনের বাইরে থেকে পাথর নিক্ষেপও বর্তমান সমসাময়িক ঘটনাগুলোর অমীমাংসিত একাংশ!

আর তাই শাটলের পুরোনো ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং শিক্ষার্থীদের মনোদৈহিক সুরক্ষা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ মনন-মানসিকতার কথা মাথায় রেখে প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে রাখতে হবে কার্যকর অবদান। দ্রুততার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এ ক্ষেত্রে শাটলে নিশ্চিত করতে হবে পরিচয়পত্র সমেত যাতায়াত। যাতায়াতের কষ্ট লাঘব করতে শাটলে পর্যাপ্ত বগি বৃদ্ধি, গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে সিলিং ফ্যানগুলোর পরিবর্তন ও নতুন সংযোজন, স্থানীয় বাসিন্দাদের অনুপ্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধকরণ, শাটলের অভ্যন্তরে ছাত্ররাজনীতির দৌরাত্ম্য দমন, শিক্ষার্থীদের অধিকার সমানভাবে নিশ্চিতকরণ, শাটলের সৌন্দর্যবর্ধন, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিধান ইত্যাদি বিষয়গুলো আমলে নিয়ে এগোতে হবে। তৈরি করতে হবে পুরোনো সেই ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সুদৃঢ় বন্ধন। তবেই ক্যাম্পাসের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক শাটল তার পুরোনো যৌবন ফিরে পাবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফিরে আসবে সরলতায় পরিপূর্ণ প্রশান্তিদায়ক শাটল ভ্রমণ।

মো. মিজানুর রহমান
শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়