সেই সুন্দর একটি ভোরের অপেক্ষায়...
২০১৯ তোমাকে বলছি।
তুমি কেমন আছ? উত্তর দিচ্ছ না। ক্ষতি নেই। সময়ই বলে দেবে কেমন আছ। অপরিচিত কারও সঙ্গে কথা বলা কষ্টকর। তারপরও এই ঝুঁকিটা নিচ্ছি। তোমাকে বলতে চাই, কতগুলো গোপন বেদনার কথা। জানো, একসময় আমিও মানুষ ছিলাম। কেন? তুমি কি এখন মানুষ না? হয়তো। কিন্তু সেই মানুষ না।
তিনিই সেই মানুষ, যিনি সমস্ত পৃথিবীর হয়ে দুঃখ পান। নাফ নদীর অথই জলে মৃত শিশু ভাসতে দেখে আমি তো দুঃখ পাই না। বোমায় বিধ্বস্ত ঘরের মধ্যে একমাত্র বেঁচে যাওয়া রক্তাক্ত শিশুর জন্য কেঁদে উঠি না। লাখ লাখ মানুষ নদীতে ভাসতে দেখে, নারী–শিশুকে ধর্ষিত হতে দেখে, পুরুষদের সার বেঁধে গুলি খেতে দেখে বেদনায় চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরেনি। ২০১৯, তুমি জানো? যিনি মানুষ, তিনি ঝরাপালকের বেদনায়ও কষ্ট পান। এমনভাবে শিশিরভেজা ঘাসের বুকে পা ফেলেন যেন মাটির বুকেও কষ্ট না লাগে। আমার তো এমন হয় না। আমার কারণে কেউ হয়তো দুঃখ পান।
চারদিকে এত অন্যায়, অমানবিকতা দেখি। অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা দেখি। গুম, খুন, হত্যা, ধর্ষণের কথা শুনি। হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের কথা শুনি। কই? আমি তো কোনো প্রতিবাদ করি না। চিৎকার করে বলি না বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় এসব চলবে না। আমি তো লজ্জায় মাথা নত করি না। ২০১৯, তাই তোমাকে বলছিলাম একসময় আমিও মানুষ ছিলাম।
এই তো মাত্র সেদিন সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থী রাজীব ও মিমের রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম। সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী শাকিলকে বাস থেকে ফেলে হত্যা করা হলো। এক ঘাতক যান হাত ছিঁড়ে নিয়ে গেল এক যাত্রীর। সেই যাত্রীকে দেখিনি। সেই হাত আমি দেখেছি। সেই হাত এই গ্রহের মানুষের কাছে নালিশ জানিয়েছিল। তোমরা এই অন্যায় মেনে নিয়ো না। কিন্তু আমি তো মেনে নিয়েছি। সেসবের পরও প্রতিদিন সড়কে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এই বেটা ২০১৯! এরপরও তুমি আমাকে মানুষ বলবে? রাগ করো না ভাই। রাগে, দুঃখে, বেদনায় অনেক সময় নীল হয়ে যাই। মাথা ঠিক থাকে না। তোমাকে তো আগেই বলেছি, তোমাকে কিছু গোপন বেদনার কথা বলব। যাকে ভালো বাসা যায়, তার সঙ্গে রাগও করা যায়।
মৃত্যুর চেয়ে নিঃশব্দ আর কী হয়? সব্যসাচী লেখক, পরানের গহিন ভেতরের লেখক অমর কথাশিল্পী সৈয়দ হক চলে গেলেন। এখনো মৃত্যুর গন্ধ শুকায়নি। মাত্র কয়েক দিন আগে চলে গেলেন ‘গোলাপী এখন ট্রেনের মতো’ অনেক নান্দনিক সিনেমার নির্মাতা নন্দিত চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন। কিসের মৃত্যু, কিসের ধ্বংস—কোনো কিছুই আমাকে স্পর্শ করে না। খাই দাই। ঘুমাই। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিই। সন্ধ্যা হয়। ভোর আসে। আবার আরেকটি ভোরের জন্য অপেক্ষা। ২০১৯ তোমার কি মনে হয় এখনো আমি মানুষ আছি?
যে সময় তোমার সঙ্গে কথা বলছি, সে সময়ে প্রচণ্ড শীতে কাঁপছে সারা দেশ। গরিব মানুষ নিশ্চয়ই শীতে কষ্ট পাচ্ছে। আমাদের একটি জনপদ উত্তরবঙ্গ। সেখানে সবকিছু বেশি বেশি। দারিদ্র্য বেশি, নিরক্ষরতা বেশি, শীত বেশি। প্রায় প্রতিবছর এখানে শীতে মানুষ মারা যায়। এবারও তারা শীতে হয়তো আরও বেশি কষ্ট পাবে। আমি তো লেপের মধ্যে শুয়ে নাক ডাকছি। অনেকগুলো কাপড় পরেও বলছি, আহ! কী শীত। আমি হয়তো অনেক কিছু বুঝি না। কতকগুলো মানুষ শীতে কষ্ট পাবে, সেটা তো বুঝি। কই আমি তো এসব মানুষের জন্য কিছু করছি না। তাই তো তোমাকে বলছিলাম ২০১৯, আমি আর আগের মতো নেই।
এই যে ধরো না, আমাদের শিশুদের শৈশব বলে কিছু নেই। তোমার জানার কথা না। আমরা তখন শৈশবে। আমরা জানি। আমাদের শৈশব কত আনন্দের ছিল। সে সময় পড়ালেখা ছিল অকাজ। কাজ ছিল গ্রীষ্মের দুপুরে ঢিল ছুড়ে আম পাড়া। পাখি ধরা। নদীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কাটা। ঘুড়ি ওড়ানো। দাঁড়িয়া বান্ধা, ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন আরও কত–কী খেলা। রাতে দাদা-নানির কাছে গল্প শোনা। জোনাকি ধরা। এ পাড়ায়–ও পাড়ায় ঘোরাঘুরি। সে এক দারুণ সময়! তোমাকে বলে বোঝানো যাবে না। এখনকার শিশুরা সেসব চিন্তাই করতে পারে না। আমরা বড়রা তাদের শৈশব কেড়ে নিচ্ছি। কেড়ে নেওয়া উচ্চারণটা দুর্বল লাগছে। শৈশব হরণ করছি বা লুট করছি। তাদের কেবল পড়া, পড়া আর পড়া। প্রচণ্ড শীতের ভোরে নিজের ওজন থেকে বেশি ওজনের বইয়ের বোঝা নিয়ে স্কুলে যাওয়া। স্কুল থেকে ফিরে কোচিং। কোচিং থেকে ফিরে বাড়িতে টিচারের কাছে পড়া। খেলার মতো তাদের সময় কই? এমনকি ঠিকমতো ঘুমাতেও পারে না। মাত্র এক-দুই নম্বর কম পেলে অভিভাবকদের সে কী বকাঝকা! এই তো কয়েক মাস আগের ঘটনা। চাঁদের মতো ফুটফুটে দুটো শিশু অরণি, আলভি। নিজের মা গলাটিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। পড়াশোনায় একটু অমনোযোগী ছিল। এইটুকু তাদের অপরাধ। এখনো বাতাসে ফিরছে এই শিশুদের মৃত্যুর গন্ধ।
তুমি বলো, ২০১৯, কোনোভাবে এটা মেনে নেওয়া যায়? এত মিষ্টি দুটো শিশু। আমি নিশ্চিত তুমি দেখলে চোখের পানি ধরে রাখতে পারতে না। আমি পেরেছি। আমাদের শিশুদের শৈশব হরণ করার বিরুদ্ধে, জিপিএনির্ভর শিক্ষার বিরুদ্ধে। আমি কি চিৎকার করে বলেছি, তিরিশ লাখ মানুষ রক্ত দিয়ে যে দেশ স্বাধীন করে, সে দেশে এ অনিয়ম চলবে না। এসব বন্ধ করতে হবে। আর এ জন্যই তোমাকে বললাম, একসময় আমিও মানুষ ছিলাম।
আরও অনেক কষ্টের কথা আছে। সব কি আর বলা যায়? আগে আমরা গরিব ছিলাম। কিন্তু আমাদের একজনের প্রতি অন্যজনের গভীর ভালোবাসা ছিল। মায়া–মমতা ছিল। আবেগ–অনুভূতি ছিল। মানুষের সুখে-দুঃখে অন্তরাত্মা দিয়ে পাশে থাকার চেষ্টা করতাম। এখন মধ্য আয়ের দেশ আমাদের ঐশ্বর্য দিচ্ছে। কিন্তু কেড়ে নিচ্ছে মানুষের প্রতি মানুষের, ভালোবাসা, সহমর্মিতা। কাছে থাকা, পাশে থাকার মানসিকতা। আমরা ক্রমশ একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। এখন আগের মতো কেউ কারও কথা শোনে না।
তোমাকে নিরন্তর শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা ২০১৯। তুমি এতটা সময় আমাকে দিলে। অনেকটা সময় নিয়ে আমার কথা শুনলে। তোমাকে বেদনার কথা বলতে পেরে কিছুটা হালকা লাগছে। বিদায়ের আগে একটু অনুরোধও করে রাখি তোমাকে। ২০১৭-১৮ আমাদের অনেক দুঃখ দিয়েছে। বলা যায় অনেক বেশি মন খারাপ করেছে। তুমি ওদের মতো হয়ো না। তুমি ভালো হয়ে এসো। আপন হয়ে এসো। বন্ধু হয়ে এসো। তোমাকে নিয়ে যেন ২০২০–এর কাছে আমাদের অভিযোগ করতে না হয়। ২০১৮ আমাদের কষ্টের কথা শুনতে পায়নি। আমাদের বেদনাবোধ তাকে স্পর্শ করেনি। ২০১৯ তুমি এমন হও যেন তোমাকে এসব বলতেই না হয়। এমন কোনো ঘটনা দেখতে চাই না যা অন্যকে কষ্ট দেয়। অন্যের বেদনার কারণ হয়।
আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, মত, পথ হয়তো আলাদা। কিন্তু আমাদের দুঃখ, আমাদের অশ্রু, আমাদের আনন্দ, আমাদের রক্তের রং সব এক। স্রষ্টার কাছে সবাই সমান। কারও প্রতি তার বৈষম্য নেই।
বিগ ব্যাং নামে একটি বিখ্যাত থিওরি আছে। এই থিওরি মতে, ১০ থেকে ২০ বিলিয়ন বছর আগে এক মহা বিস্ফোরণ হয়েছিল। এ বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে এই মহাবিশ্বের যাত্রা। তরপর পৃথিবী ঘুরছে সূর্যের চারদিকে। গ্যালাক্সির চারদিকে ঘুরছে সূর্য। আবার নিউক্লিয়াসের চারদিকে ঘুরছে অতিক্ষুদ্র ইলেকট্রন। এমনি করে জন্মের পর মৃত্যুও একটা চক্র। এই চক্র শেষ না হওয়া পর্যন্ত পৃথিবীতে মানুষ থাকবে। তোমার কাছে প্রার্থনা, এই মানুষ যেন ভালো থাকে।
নিউটন একসময় মনে করতেন, সবকিছুর অবস্থান এই প্রকৃতির মধ্যে। প্রকৃতির কোনো অনিশ্চয়তা নেই। তাই আমাদের ওপরও কোনো অনিশ্চয়তা নেই। নিউটনের এই মনে করা আমাদের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। আমরা প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। তোমার কাছে প্রার্থনা, তুমি আমাদের অনিশ্চয়তা, দুঃসময়, আমাদের দুঃখ-বেদনা-কষ্টের কারণগুলো আর যেন ফিরে না আসে।
অনেক না–পাওয়ার মধ্যে একটি ভালো খবর দিই। তোমার আসার মাত্র দুদিন আগে একটি নির্বাচন হলো। তোমাকে উপহার দিলাম একটি নতুন সরকার। তুমি তাদের সঙ্গে থেকো। তারা যেন একটি নতুন ভোর এনে দেয়। সেই সুন্দর একটি ভোরের অপেক্ষায় থাকব আমরা। ভালো থেকো ২০১৯।
আশফাকুজ্জামান: সাধারণ সম্পাদক, মুক্ত আসর; সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রথম আলো বন্ধুসভা (জাতীয় পর্ষদ)