স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম এত বেশি কেন

স্যানিটারি ন্যাপকিন বা স্যানিটারি প্যাড হলো প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রতি মাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ে নারীদের ব্যবহৃত শোষক বস্তু। বাজারে বিভিন্ন ধরনের স্যানিটারি প্যাড পাওয়া যায়। প্যান্টি লাইনার, নিয়মিত, ওভারনাইট ইত্যাদি। মূলত মেয়েদের ঋতুস্রাব বা পিরিয়ডের সময় এই স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে হয়। ঋতুস্রাব মানে হলো একজন কিশোরী মেয়ের সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা লাভ করা। এটি কোনো নিষিদ্ধ বা ট্যাবু-জাতীয় বিষয় নয়। আবার এটি কোনো সামাজিক বা পারিবারিক ব্যাধিও নয়। এটি কোনো জন্মগত অভিশাপ নয়। এটি এমন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে বোঝা যায় একজন কিশোরী পরবর্তী জীবনে মাতৃত্বের অধিকারী হতে পারবে কি না।

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মেয়েরা ঋতুস্রাবের সময় তাঁদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন বা কাপড় ব্যবহার করে থাকেন। অনেকে আবার তুলা ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু কাপড় বা তুলা ব্যবহার করার কারণে অনেক মেয়েরই প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত হয় না। ফলে পরবর্তী জীবনে তাঁদেরকে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা সম্মুখীন হতে হয়। জরায়ু ক্যানসারের মতো গুরুতর একটি সমস্যার সম্মুখীন নারীদের হতে হয়। ফলে পরবর্তী সময়ে নারীদের জরায়ু অস্ত্রোপচার করে কেটে ফেলতেও হতে পারে। গ্রামীণ এলাকায় এই প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ে কিশোরীদের মধ্যে বেশ উদাসীনতা লক্ষ করা যায়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা মায়ের কাছ থেকে ঋতুস্রাবের সময় বা মাসিক হওয়ার সময় কাপড় অথবা তুলো ব্যবহার করার পদ্ধতি জেনে এসেছে। কিন্তু এই প্রাচীন পদ্ধতির কুফল সম্পর্কে তারা এখনো পুরোপুরিভাবে অবগত হয়নি।

আর নতুন পদ্ধতিতে ব্যবহৃত স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করার পদ্ধতি সম্পর্কে তারা ভালোভাবে অবগত নয়। কিন্তু কাপড় বা তুলার চেয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিনের স্বাস্থ্য সুরক্ষার মাত্রাটা অনেক বেশি। তাই সবারই উচিত নিজেদের শারীরিক সুস্থতার কথা চিন্তা করে ঋতুস্রাবের দিনগুলোতে স্যানিটারি প্যাড বা ন্যাপকিন ব্যবহার করা। মূলত অসচেতনতা স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার না করার একটা বিষয়, কিন্তু সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে স্যানিটারি ন্যাপকিনের উচ্চমূল্য; অর্থাৎ স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্যাডগুলোর দাম অনেক বেশি হওয়ার কারণে মূলত শহর বা গ্রামীণ এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নারীদের পক্ষে এই প্যাড কিনে ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের পরিবারের নারীদের জন্য বিষয়টি খুবই ব্যয়বহুল। ফলে ইচ্ছা থাকলেও তাঁরা ঋতুস্রাবের দিনগুলোতে স্যানিটারি ন্যাপকিন বা স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করতে পারেন না।

বাজারে বর্তমানে কয়েকটি কোম্পানির বিভিন্ন ধরনের স্যানিটারি ন্যাপকিন পাওয়া যায়। যেগুলোর দাম ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ২৮০ টাকা পর্যন্ত। যাঁদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তাঁদের জন্য এই প্যাড কেনার বিষয়টা নিছক বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মনে হয়। একেবারে যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো। দরিদ্র জনগণের মাসিক আয় থেকে যদি এ খাতে অতিরিক্ত ১৫০ টাকা করে খরচ করা হয়, তাহলে সংসারে অন্যান্য খরচে তার প্রভাব পড়ে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিং বেজলাইন সার্ভে থেকে জানা যায় যে শুধু স্যানিটারি ন্যাপকিনের উচ্চমূল্যের কারণে ১০ ভাগের বেশি নারী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে পারেন না। বাকি ৮৬ ভাগের ওপরে নারীদের ঋতুস্রাবের দিনগুলোতে পুরোনো কাপড় ব্যবহার করতে হয়। নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য যা খুবই অস্বাস্থ্যকর।

বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রস্তুতির নানা ধাপে কর পরিশোধ করতে হয়। ভালো ভালো স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির জন্য বিদেশি কাঁচামাল আমদানি করার জন্য অনেক বেশি অর্থ ব্যয় হয় আর এ জন্যই পরবর্তী সময়ে প্রান্তিক পর্যায়ের নারীদের কাছে এই স্যানিটারি প্যাড অনেক দামে বিক্রি করা হয়। কিন্তু নিরাপদ নারীস্বাস্থ্য এবং মাতৃত্ব বজায় রাখতে হলে অবশ্যই ঋতুস্রাবের দিনগুলোতে মেয়ে বা কিশোরীদের স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করা উচিত। প্রান্তিক পর্যায়ের নারীসহ সবাই যেন এই স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করার সুবিধা লাভ করতে পারেন, সে জন্য অবশ্যই এর ক্রয়মূল্য হ্রাস করা উচিত। এতে নিম্ন আয়ের পরিবারের নারীদের স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের প্রতি আগ্রহ যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি নারীদের নিরাপদ প্রজনন স্বাস্থ্য বজায় থাকবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব এই স্যানিটারি প্যাডের ক্রয়মূল্য হ্রাস করা হোক।

সানজিদা মাহমুদ মিষ্টি
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর)
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়