আমার বন্ধু লাভলুর ধীশক্তি ও রসবোধ

তার ডাকনাম লাভলু এবং ভালো নাম আবু মুসা খালেদ। তার বাড়ি জামালপুর। রাশিয়া আসার পূর্বে সে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিল।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে আমরা অনেকেই স্নাতক পর্যায়ে বৃত্তি পেয়ে পড়তে যাই। বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে এতজন ছাত্র এর আগে আর বিদেশে পড়তে যায়নি। ইন্টারউইং স্কলারশিপে আমাদের ছাত্ররা পশ্চিম পাকিস্তানে পড়তে যেত। আমার বেশ কয়েক কলেজশিক্ষক এই বৃত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রথম শ্রেণি পেয়ে পাস করেছে, যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সে দ্বিতীয় শ্রেণি। এতে আমার গর্বের সীমা ছিল না।

যাহোক পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে যেত শতাধিক। তারই দ্বিতীয় ব্যাচে ১৯৭৩ সালে আমিও পড়তে যাই। একটি ছেলে বাসের এক সদস্যকে পিঠাপিঠি K ও উল্টো K দেখে জিজ্ঞাসা করছিল, এটা কী একটি বর্ণ না একটি শব্দ? উত্তর এল—বর্ণ। এত কসরত করার পর মাত্র একটি বর্ণ? পরবর্তী প্রশ্ন, কত ঘন ঘন এই বর্ণ লিখতে হয়? তার উত্তর এল—মাঝেমধ্যেই।

এটা শুনে রাজপুত্রের মতো দেখতে ছেলেটির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। যে ছেলেটি বিমানবন্দর থেকে হলে পৌঁছানোর বাস থেকে K ও উল্টো K মিলে যে জটিল অক্ষর হয়, তার অস্বস্তিতে দেশে পর্যন্ত ফিরে আসতে চেয়েছিল, তাকে নিয়েই এই কলাম।

আস্ত্রাখানে প্রিপারেটরি কোর্স শেষ করে আমরা ছয়জন—গিয়াস, মনসুর, ফিরোজ, শমসের, লাভলু ও আমি ওদেসা ইনস্টিটিউট অব মেরিন ইঞ্জিনিয়ার্সে এবং ইফতেখার ওদেসা ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ইকোনমিতে ভর্তি হলো। অসম্ভব সুন্দর জীবন আমাদের শুরু হলো। যার উপস্থিতি আমাদের জীবনকে এমন আনন্দময় করেছিল, তার ডাকনাম লাভলু এবং ভালো নাম আবু মুসা খালেদ। তার বাড়ি জামালপুর। রাশিয়া আসার পূর্বে সে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিল।

লাভলু সব সময় হাসিখুশি থাকত। সবাইকে আনন্দ–উল্লাসে রাখতে তার জুড়ি ছিল না। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিল। তারপরও দেখেছি, ভিন্নমতের ছাত্রদের সঙ্গেও তার সখ্য ছিল। শুধু তা–ই নয়, তার সঙ্গ, বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধ সব সময় আমরা সবাই উপভোগ করতাম। ভিন্নমতের মানুষের সঙ্গেও যে আনন্দের সঙ্গে সময় কাটানো যায়, জীবনকে উপভোগ করা যায়, আজ আমাদের সমাজে তা অনুমান করাও কঠিন।

আজ অর্ধশতাব্দী পর লাভলুর প্রসঙ্গ কেন এল, তার একটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন।

ছবিটি আমার অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু লাভলুর। আমার বয়স বেড়ে ৬৯ হয়েছে। ১৯৮১ সালের ২০ জুলাইয়ের পর লাভলুর বয়স আর বাড়েনি, ২৮–এ থেমে গেছে। আমরা যারা লাভলুকে চিনি, তাকে কখনো মধ্যবয়সী কিংবা প্রৌঢ় ভাবতে পারি না কিংবা জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত–পরিশ্রান্ত, নানা সমস্যায় বিধ্বস্ত ভাবতে পারি না। কারণ সে ছিল প্রাণোচ্ছল, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা, এমনকি বিধ্বস্ত অবস্থায় যার কাছ থেকে অনেক উদ্যম, শক্তি ও প্রেরণা পাওয়া যেত।

মাইক্রোবাসের একটি দুর্ঘটনায় লাভলু হারিয়ে গেছে। কিন্তু আমরা যারা লাভলুর বন্ধু ছিলাম, যারা ছিলাম পরিচিত শ্রেণিকক্ষের সাথি, তাদের মনে এখনো লাভলু চিরসবুজ, রম্যরসের অফুরন্ত আধার।

লাভলুর মৃত্যুর ৪২ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। অনেক আগেই তার সম্পর্কে লেখা উচিত ছিল। কয়েক দিন আগে বুয়েটের সোনালী ব্যাংকে লাভলুর ছোট বোন ডোরার বর ড. রাকিবের সঙ্গে দেখা। তারই উদারতায় পরিচয় এবং লাভলুর প্রসঙ্গ।

রাকিব ক্যালিফোর্নিয়ায় শিক্ষকতা করেন এবং তাঁর স্ত্রী ডোরা বুয়েট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং করে ক্যালিফোর্নিয়ায় চাকরিরত। বিটিভির একসময়ের স্বনামধন্য প্রযোজক শাহিদা আরবি লাভলুর বড় বোন। লাভলুর এক ভাই চার বোন—সবাই নিজ নিজ স্থানে সুপ্রতিষ্ঠিত।

আরও পড়ুন

লাভলু জামালপুরের এক উচ্চশিক্ষিত সাংস্কৃতিক পরিবারে বেড়ে ওঠে। রাকিবের সঙ্গে লাভলুকে নিয়ে অর্ধশতাব্দী আগের ঘটনাগুলো ফিরে দেখার সুযোগ হলো।

লাভলু শুধু অসম্ভব মেধাবীই ছিল না, তার পর্যবেক্ষণক্ষমতা ও বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধের তুলনা পাওয়া ভার। নানা ঘটনার মধ্যে এর সামান্য কিছু ছাপ তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ঘটনাগুলো ঘটেছে ১৯৭৩-১৯৭৯ সালে, যখন আমরা উচ্চশিক্ষার্থে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে অধ্যয়নরত।

যদিও ঘটনাগুলো অর্ধযুগ আগে ঘটেছে, তবু পার্শ্বচরিত্রগুলোর জন্য বিব্রতবোধের কারণ যাতে না হয়, সে জন্য স্থান–কাল কিছুটা পরিবর্তন করে দেওয়া হলো।

১. ক্লাস থেকে এসেছি; সবাই ক্লান্ত, অবসন্ন ও ক্ষুধার্ত। মেস করে দেশের খাবার খাওয়ার চেষ্টা করি। এর মধ্যে দেখি, আমাদের চাল নেই। দোকানে গিয়ে আনতে সময় লেগে যাবে।

আমরা জানি, গোটা রাশিয়ায় চালের অভাব হলেও রাজন ও জুজুর মেসে তার অভাব হবে না। কারণ, তারা যথেষ্ট পরিকল্পনা করে চলে। পরিকল্পনাটি মাত্র ১০ মাসের জন্য। কারণ, তারপর এ শহরে থাকা হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তার জন্যই এ রকম স্বল্পকালীন পরিকল্পনা! যাহোক, লাভলু গিয়ে রাজনের কাছে এক প্যাকেট চাল চাইল। তাদের গোলায় যথেষ্ট চাল রয়েছে। রাজন খুবই যুক্তি দিয়ে বোঝাল যে চাল যেহেতু শুধু তার একার নয়, এ জন্য সে একা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। ফলে লাভলু জোর করেই এক প্যাকেট চাল নিয়ে চলে এল।

আমরা মেসের কেউ এ বিষয়ে জানি না। কিছুক্ষণ পর জুজু এসে লাভলুর জোরজবরদস্তির কথা অত্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ভদ্রভাবে জানিয়ে গেল। আমরা সবাই লাভলুকে বললাম, কাজটি ঠিক হয়নি। সুতরাং রাজনের কাছে ক্ষমা চেয়ে আসতে পরামর্শ দিলাম। লাভলু গিয়ে রাজনকে বলল, কাজটি ভুল হয়েছে, সে যেন ক্ষমা করে দেয়। তবে তার সঙ্গে জুড়ে দিল যদি ক্ষমা না করে, তাহলে তাকে সে রীতিমতো ধোলাই দেবে।

২. আশপাশে যত ঘটনা ঘটত, লাভলু আমাদের তুলনায় অনেক বেশি নিবিড়ভাবে আগ্রহ নিয়ে তা পর্যবেক্ষণ করত। যেমন অন্তত ২০ জনের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার শব্দ শুনে বুঝে ফেলত, কে উঠছে।

আমরা মেস করে একসঙ্গে তিন–চারজন বাংলাদেশি খাবার খেতাম। এর মধ্যে অবশ্য দু-একজন ছিল, যারা কারও সঙ্গে মেস করতে পারেনি। ফলে তাদের দেশি খাবার খাওয়াও হতো না। তারা অনেক সময় খাওয়ার সময় এসে ভাগ বসাত। একসময় এটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিল, কীভাবে বাড়তি বোঝাটি নামানো যায়?

লাভলু বলল, এর ব্যবস্থা সে করতে পারবে। মাখন বলে একজন ছাত্র এ প্রকৃতির ছিল। সে দরজায় নক করলে লাভলু বলত, দরজা খুলিস না। কারণ, মাখন নক করছে। এ রকম সে কমপক্ষে ২০ জন দেশি–বিদেশি ছাত্রের দরজা নক করার শব্দ থেকে চিনতে পারত, যেমন কাশির শব্দ, হাসির শব্দ, করিডর দিয়ে কিংবা সিঁড়ি বেয়ে হাঁটার শব্দ থেকেও!

৩. একবার এক রুশ ছাত্র আমাদের খাবার খেয়ে তো মহাখুশি এবং নিয়মিত আমাদের রুমে হানা দেওয়া শুরু করল। এর থেকে পরিত্রাণের একটি শোভন সমাধান লাভলু দিল। সেদিন তরকারিতে প্রচুর ঝাল দেওয়া হলো। ওই রুশ ছাত্র খেলে তার সাদা মুখমণ্ডল রীতিমতো লাল হয়ে যায়। সে লালা ফেলতে ফেলতে চলে গেল। দুদিন পর আবার এসে প্রথম প্রশ্নই করে, ঝাল কি না। উত্তর—ওই দিনের থেকে কিছুটা বেশি। এরপর আর সে আমাদের রুমে খাওয়ার জন্য হানা দিত না।

৪. উপস্থিত বুদ্ধিতে লাভলুর জুড়ি ছিল না। সহপাঠীদের সহজেই বোকা বানাতে পারত। লাভলুর বাজি—‘চাঁদ উঠলে আমি জিতব, তারা উঠলে তুই হারবি।’ এতে আমরা যে কতবার বোকা হয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই।

ডাক্তার বন্ধুকে সে বলত, ‘তোর বাবার দুই ছেলে। একজন বুদ্ধিমান, আরেকজন ডাক্তার।’ কৃশকায় পুরু চশমার রবিকে কেউ তার ওজন সম্পর্কে প্রশ্ন করলে লাভলুর উত্তর, ‘চশমাসহ–ছাড়া অবস্থায় ৫% কমবেশি হয়, গোসলের আগে– পড়ে ১০%, শীতে–গরমে ২০%।’  

দেখে আসার পর—সিনেমাটি কী রকম, তার উত্তরে লাভলুর কথা, ‘অভিনয়টি অনবদ্য ছিল!’ কিংবা ঢাকা কলেজের সামনে পান সিগারেট বিক্রেতাকে বলত, ‘আর দুই আনার সিগারেট বাকি দে, এক টাকা দুই আনা পুরা হোক।’ এ রকম কত যে উপভোগ্য কথা লাভলুর থেকে শোনা যেত!

৫. আমরা চার বন্ধু মিলে মেস করে মাঝেমধ্যেই দেশি খাবার রান্না করি। খাওয়াদাওয়া শেষে যা রইল, তার দিকে আমাদের দুজনের আগ্রহ না থাকলেও লাভলু আর রাফির আগ্রহ অবশিষ্টের ওপর। যাহোক, এর সুরাহা করতে রান্নাঘরের চাবি পালাক্রমে এই দুজনের কাছে থাকত।

আমাদের বাসস্থান ইউক্রেনের ওদেসা শহরে কৃষ্ণসাগরের তীরে। গ্রীষ্মে অসম্ভব গরম আবার শীতকালে তীব্র শীত। তাই বলে শীতকালে যে সান্ধ্যভ্রমণ বাদ যায়, তা–ও নয়। অনেক সময় প্রায় মধ্যরাতে হলে ফিরি, তারপর রান্না–খাওয়া।

যাহোক, একদিন রাত দেড়টায় খাওয়া শেষ করেছি লোভনীয় গোমাংস দিয়ে। রান্নাঘরের চাবি রাফির কাছে। গরুর মাংস গরম করার পাঁচ মিনিটের মধ্যে জমে যায়, আবার গরম করতে হয়। হলের প্রতি রুমে চারজন ছাত্র দুজন রুশ আর দুজন বিদেশি।

আমার রুমে আমি আর লাভলু—দোতলা খাটে আমি নিচে, লাভলু ওপরে। রাত দেড়টায়ও তার ঘুম আসছে না। জিজ্ঞেস করলাম, কেন সে ঘুমাচ্ছে না। তার উত্তর, রাফির কাছে চাবি। সে ভাবছে সকালে যখন খেতে আসবে, তখন আমি খাওয়ায় ভাগ বসাব। এ জন্য সে ভাবছে, অবশিষ্ট খাবার এখনই খেয়ে ফেলবে। আমার জিজ্ঞাসা, তা কী করবি?

সে বলল, রাফি মাংস গরম করতে দিয়ে যখন বাথরুমে যাবে, তখন সে রান্নাঘরে ঢুকে পড়বে এবং খাওয়ায় ভাগ বসাবে। বন্ধু কী ভাবতে পারে, তা যথেষ্ট যুক্তি দিয়ে সিদ্ধান্তে আসছে। ভরা পেটে মানুষ এগুলো ভাবতে পারে! উল্লেখ্য লাভলু তার অনুমানে নিখুঁত ছিল এবং যা ভেবেছিল, ঘটনাটি ঠিক সেই অনুক্রমেই ঘটেছিল।

৬. তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের হালকা শিল্পসামগ্রীর মান তত ভালো ছিল না, যদিও ভারী শিল্পের গুণগত মান ভালো ছিল। তা না হলে কী মানবসভ্যতার প্রথম দেশ হিসেবে কৃত্রিম উপগ্রহ নিক্ষেপ করে?

রুশদের বিদেশি সামগ্রীর প্রতি অসম্ভব উন্মাদনা ছিল। একটি বিদেশি জিনসের প্যান্ট কিংবা ঘড়ি তাদের জন্য স্বপ্ন। একটি ঘড়ির দাম ১০০ রুবল হলে তার ডায়ালে কোনোভাবে ‘মেড ইন জাপান’ লিখতে পারলে সেই লেখা ঘষামাজা করা কি না, তা–ও দেখবে না। ঘড়ির দাম পাঁচ গুণ হয়ে যাবে। হালকা সামগ্রীর গুণের একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।

আমার এক বন্ধুকে রাশিয়ার একটি ঘড়ি উপহার দিয়েছিলাম, নাম সেকুন্ডা, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে। তখনো দেশে এ রকম স্বয়ংক্রিয় ঘড়ি নজরে পড়েনি। আমার বন্ধু খুবই খুশি। মাসখানেক পর সে জানাল, স্বয়ংক্রিয় ঘড়ি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়েছিল বলে একটু চাবি ঘুরাতে হয়েছে। তবে সে তা–ও খুশি প্রতিদিন তো আর আঙুলের অনুশীলনী করতে হয় না।

কিছুদিন পর জানাল, সপ্তাহে সপ্তাহে চাবি ঘুরাতে হয়। তা–ও তার কাছে গ্রহণযোগ্য। এরপর জানাল, প্রতিদিনই চাবি দিতে হয়। তারপর আর সে জানায়নি ঘণ্টায় ঘণ্টায় কিংবা মিনিটে মিনিটে চাবি দিতে হয় কি না। ভাগ্যিস, চাবি দেওয়ার ব্যবস্থাটি ছিল। রুশদের এই দুর্বলতাকে কেন্দ্র করে লাভলুর হাসিঠাট্টা খুবই উপভোগ্য ছিল।

৭. লাভলু প্রপেলার ডিজাইনের প্রজেক্ট ডিফেন্ড করতে গিয়েছে। সারা বছর পড়ালেখার ধারেকাছে নেই। অন্যদের দিয়ে করিয়েও কোনো লাভ নেই। কারণ, স্যাররা এমনই পার্শ্বপ্রশ্ন করে থাকেন, যার উত্তর দিতে হলে প্রজেক্টের খুঁটিনাটি জানতে হয়।

যাহোক, তিন সদস্যের কমিটির কাছে দেয়ালে ড্রয়িং শিট টানিয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর মুখ্যত প্রচুর বুদ্ধিমত্তার কারণে সফলভাবে দিয়েছে। এর মধ্যে একজন শিক্ষক প্রশ্ন করলেন, প্রপেলার জাহাজের বডির সঙ্গে কীভাবে লাগাবে? লাভলুর উত্তরটি জানা নেই, তবে বুদ্ধিমত্তা ও রসবোধের বিন্দুমাত্র অভাবও নেই। লাভলুর উত্তর, ২০ টন ওজনের প্রপেলার জাহাজের বডির সঙ্গে জাপানি আঠা দিয়ে লাগাবে। জাপানি আঠা, আর রুশদের জাপানি সামগ্রীর প্রীতি বলে কথা!

৮. ‘ডেসক্রিপটিভ জিওমেট্রি’ নামের একটি কোর্স ছিল, যাতে বিভিন্ন ত্রিমাত্রিক বস্তুর ছেদরেখা ইত্যাদি বের করতে হতো। লাভলুর অবশ্য বই পড়ার কোনো সময় ছিল না। ফলে যেসব তত্ত্বের বলে নানা রকম স্ট্রাকচার আঁকা যায়, তা লাভলুর জানা ছিল না। তবে এই স্ট্রাকচারগুলো কী রকম হবে, তা লাভলু তত্ত্ব ছাড়াই বলে দিতে পারত।

পরীক্ষার সময় তার এ রকম একটি সমস্যা পড়েছে। লাভলু আঁকতে আঁকতে খাতার পাতা ছিঁড়ে ফেলে আরেকটি নিয়েছে। যাহোক, যখন সে সমস্যাটি সমাধান করতে পারল, তখন স্যারকে দেখানোর জন্য নিয়ে গেল।

লাভলুর সমাধান সম্পর্কে স্যার আমাদের একটি গল্প শোনালেন। এক লোক তার ছেলেকে নিয়ে গরুর হাটে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে ছেলেকে বলল, হাটে অনেক গরু। উত্তরে ছেলেটি বলল, ‘জি, ৭৯৯৯টি।’ লোকটি অবাক হয়ে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করল, এত অল্প সময়ে সে এতগুলো গরু কী করে গুনতে পারল? ছেলে খুবই গর্বের সঙ্গে বলল, কাজটি খুবই সোজা। পা গুনে চার দিয়ে ভাগ করেছে! লাভলুও সমস্যাটি এভাবে করেছে। তবে মনের রাখতে হবে, এ সমস্যার সমাধানের জন্য সে কোনো তত্ত্ব ব্যবহার করেনি, কেবল তার বুদ্ধিমত্তা খাটিয়েছে মাত্র!

৯. রাশিয়ায় পরীক্ষা হয় মৌখিক। পরীক্ষার শুরুতে শিক্ষক ছোট ছোট কাগজে তিনটি করে প্রশ্নের কার্ড তৈরি করে তার টেবিলের ওপর রাখেন। ছাত্র তার স্টুডেন্ট বুক (জাসিয়তনাইয়া কনিজহকা) জমা দিয়ে কার্ড তোলে।

স্টুডেন্ট বুক ভাঁজ করা আইডি কার্ডের মতো, কিন্তু আকারে দ্বিগুণ। এতে ছাত্রের নাম, বিভাগ, কোন ইয়ারে পড়ে—এগুলো থাকে প্রথম দিকের পাতায়। পরবর্তী প্রতিটি পৃষ্ঠায় ছাত্র কী বিষয়ে কত তারিখে পরীক্ষা দিল, কী গ্রেড পেল এবং শিক্ষকের স্বাক্ষর থাকে। পরীক্ষা দিতে গেলে এই কার্ড লাগে, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ঢুকতে গেলে এই কার্ড লাগে।

ছাত্রটি স্যারকে কার্ড দিলে তখন তাকে প্রশ্নের কার্ড বাছাই করতে দেওয়া হয়। ছাত্রটি ওই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য কিছু লেখালেখি করে। তারপর স্যার যখন ফ্রি থাকেন, তখন স্যারের পাশে বসে লেখালেখির সাহায্যে প্রশ্নের উত্তর দেয়। শিক্ষক প্রশ্নের উত্তর শুনে ছাত্রের বক্তব্যের বলিষ্ঠতা কিংবা দুর্বলতা বক্তব্যের স্বর থেকে অনুমান করে পার্শ্বপ্রশ্ন করেন। বিষয় সম্বন্ধে ছাত্রের ধারণা পরিষ্কার না থাকলে শিক্ষকের পার্শ্বপ্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হয় না।

এরপর ছাত্রের বিষয় জ্ঞানের ভিত্তিতে শিক্ষক স্টুডেন্ট বুকে আতলিস্না (এক্সিলেন্ট), খারাসো (গুড), উদভলেতভিরিচেলনা (পাস), ফেল গ্রেড দিয়ে থাকেন। লিখিত পরীক্ষাপদ্ধতিতে একজন ছাত্র একেবারেই না বুঝে শুধু মুখস্থ করে পূর্ণ নম্বরও পেয়ে যেতে পারে। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষাপদ্ধতিতে সে সুযোগ নেই।

লাভলু থিওরিটিক্যাল মেকানিকস পরীক্ষা দিতে গিয়েছে। পরীক্ষক হলেন নুদেলম্যান। অধ্যাপক জ্যাকভ লভয়েভিচ নুদেলম্যান অবসরে গিয়েছিলেন। স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছিল বিধায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে শিপ বিল্ডিং বিভাগে আবার পড়ানো শুরু করেন। অত্যন্ত নামকরা শিক্ষক।

রুশদের পাঠানো প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহের গতিপথ নির্ধারণে তাঁর অবদান ছিল। চমৎকার শিক্ষক। শ্রেণিকক্ষেই সব পাঠ আমাদের বুঝিয়ে দিতেন। ফলে সকাল সাড়ে সাতটায় প্রথম ক্লাস তার হলেও পাঁচটি সেকশনের ১২৫ ছাত্রই উপস্থিত থাকত। অবশ্য ওই ক্লাসের পরে আরও ক্লাস থাকলেও ছাত্ররা অনেকেই হলে ঘুমাতে যেত।

উল্লেখ্য, রাশিয়ায় শিক্ষকেরা শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর জন্য নানা বই ঘেঁটে লেকচার নোট তৈরি করেন। ছাত্ররা সাধারণত ওই লেকচার নোট পড়েই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়। যাহোক, সারা বছর বই কিংবা লেকচার নোট না পড়া লাভলু পরীক্ষার হলে পরীক্ষার শুরুতেই প্রবেশ করে পেছনের কাতারে গিয়ে বসে। সেখানে সে লেকচার নোট সম্ভবত জীবনের প্রথম পড়তে থাকে এবং তাতে তার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে তা লেখে এবং বুঝে যাতে করে স্যারের প্রশ্নের উত্তর করতে পারে।

আমাদের বন্ধু সায়েমও ওই পরীক্ষা দিতে গিয়েছে। উভয়েই ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিল। সায়েম গণিতনির্ভর কোর্সগুলোতে নিজেকে অসহায় বোধ করে বলে এ ধরনের কোর্সে পাস করলেই সে খুশি। দুজনই পরীক্ষা দিচ্ছে এবং সায়েম বুঝতেও পারল যে লাভলু তিনটি সমস্যার কোনোটিই মেলাতে পারেনি।

যাহোক, সায়েম মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে পাস নম্বর পেয়েই খুশি এবং লাভলু পরীক্ষার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে। পরিশেষে লাভলু যখন বের হলো, অনেকটা বিষণ্ন বদনে তখন সায়েম পরীক্ষার খবর জানতে চাইল।

পরিশেষে যখন জানা গেল, লাভলু এক্সিলেন্ট গ্রেড পেয়েছে, রগচটা সায়েম মুহূর্তের মধ্যে পরীক্ষার হলে ঢুকে শিক্ষককে বলল, লাভলু যে একটি সমস্যাও সমাধান করতে পারেনি, তা সে জানে। আর সে নিজে সব কটি প্রশ্নের মোটামুটি উত্তর করে সে যেখানে কেবল পাস পেয়েছে, সেখানে লাভলু কীভাবে এক্সিলেন্ট গ্রেড পেল?

উত্তরে অধ্যাপক জ্যাকভ লভয়েভিচ নুদেলম্যান বললেন, তিনি সায়েমের ক্ষেত্রে তার বোকামিকে মূল্যায়ন করেছেন। আর লাভলু বই ও নোটবুক পড়েনি, তিনি তা বুঝেছেন। তারপরও সে সমস্যাগুলোর সমাধানে তার যে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে, তা কেবল এক্সিলেন্ট গ্রেড দিয়েই মূল্যায়ন করা যায়! একজন অনিয়মিত, অনাগ্রহী ছাত্রকে নুদেলম্যানের মতো দামি একজন শিক্ষকের কত উদার মূল্যায়ন!

১০. হাইড্রোডায়নামিকসের পরীক্ষা। শিক্ষক খুবই বদমেজাজি। সাধারণত পরীক্ষায় প্রায় সক ছাত্রই ফেল করে থাকে। তারপর দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে দুর্বল গ্রেড নিয়ে পাস করে। এতেই ছাত্ররা খুশি। লাভলুর সারা সেমিস্টার পড়ালেখা নেই।

পরীক্ষার দিন অতি প্রত্যুষে সে পরীক্ষা দিতে গেল হাতে একাধিক প্যাকেটে পাস্তুরিত দুধ এবং কয়েকটি গোল পাউরুটি নিয়ে। কারণ, পরীক্ষার হলে তাকে পড়তে হবে, শিখতে হবে, তারপর তো পরীক্ষা দেওয়া। পরীক্ষাটি আবার বই খুলে পরীক্ষা। তারপরও পরীক্ষাটিকে ছাত্ররা যমের মতো ভয় পায়। কার্ড তুলে লাভলুর ভাবার কোনো কারণ নেই যে তার কমন পড়েছে। যাহোক, একেবারে পেছনের কাতারে বসে সে প্রশ্নগুলোর সম্ভাব্য উত্তর বের করে দুটির উত্তর শুদ্ধভাবেই লিখে ফেলল।

এবার তৃতীয় প্রশ্নটির উত্তর ভালোমতো বুঝে বিভিন্ন ধরনের ভুল ইচ্ছা করে করে রাখল, যাতে ভুলগুলো দেখে স্যার সেখানে নানাবিধ প্রশ্ন করে তার সময় নষ্ট করে। স্যার দুটি প্রশ্নের শুদ্ধ উত্তর দেখে তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরে নানারকম ত্রুটিবিচ্যুতি দেখতে পেলেন এবং সেগুলো নিয়ে লাভলুকে প্রশ্ন করলেন। লাভলু উত্তর জানলেও (সে তো ইচ্ছা করেই ভুলগুলো করে রেখেছে) সময় নিয়ে ধীরে ধীরে স্যারকে প্রতিটি ভুলই সংশোধন করে দিল।

এদিকে স্যারকে আরও ১০–১২ জন ছাত্রের পরীক্ষা নিতে হবে এবং সন্ধ্যা আসন্ন। তাই বাধ্য হয়েই স্যার লাভলুকে পাস গ্রেড দিতে বাধ্য হলেন, যেখানে ছাত্ররা নিয়মিত ক্লাস করেও একবারে পাস করতে পারে না। লাভলু তার আশপাশের লোকজনের মনস্তাত্ত্বিক দিকটি ভালো পড়তে পারত এবং তা নিজের সুবিধায় ব্যবহার করতে পারত। এমনকি তা পরীক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল।

১১. যেহেতু পড়ালেখা করার জন্য লাভলুর সময় বরাদ্দ ছিল খুবই কম। এত কাজের ভিড়ে এক ক্ষুদ্র জীবনে পড়ালেখাটাকে আর কতই গুরুত্ব দেওয়া যায়! তাই গোটা সেমিস্টারে শিক্ষক যা পড়িয়েছেন, তা তাকে খুবই অল্প সময়ে রপ্ত করতে হতো এবং তা সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষার আগে। সে আমাকে বলে রাখত, ক্লাসে যা পড়ানো হয়েছে, তা মাত্র ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। আমি তো নিজেকে নিয়ে রীতিমতো গর্বিত, এমন মেধাবী মানুষের পড়ালেখায় সাহায্য করার বিরল সুযোগ।

আমি আদা–জল খেয়ে লেগে পড়তাম, যাতে লাভলু প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর করতে পারি। লাভলুর সঙ্গে পড়ার সেশনে সে আমাকে এমন সব প্রশ্ন করত, যা আমি জীবনেও নিজেকে প্রশ্ন করিনি এবং যেসব প্রশ্ন খুবই বুদ্ধিদীপ্ত ছিল। আমার চেষ্টার ত্রুটি না থাকলেও তাকে সন্তুষ্ট করা যেত না এবং ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই তার শেখার আগ্রহ থাকত না আরও এ কারণে যে সে যা শিখেছে, তাতে তার পাস হয়ে যাবে এবং পাস করতও।

১২. পদার্থবিজ্ঞানের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে এসেছি, তাতে ইলেকট্রিসিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। স্প্রিংয়ের খাটে শুয়ে সদ্য কেনা গ্রুনডিগ ক্যাসেট প্লেয়ার বাজিয়ে গান শোনার চেষ্টা করছি। দেয়ালের সকেট থেকে ঠিকমতো ক্যাসেট প্লেয়ারটি পাওয়ার পাচ্ছে না। অনেক কসরত করার পরও যেহেতু ঠিকমতো কানেকশন পাচ্ছে না, বারবার সংযোগ নষ্ট হচ্ছে, সুতরাং আর কী করা! কাগজ দিয়ে প্যাডিং করে দিলাম—রীতিমতো বিদ্যুৎ অপরিবাহী একটি বস্তু দিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। তা–ও কাজ হচ্ছে না। এমন সময় লাভলু রুমে ঢুকল।

আমি তাকে সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের বিমাতাসুলভ আচরণের জন্য অভিযোগ করলাম। লাভলু আমাকে উত্তরে জিজ্ঞাসা করল, আমি কি পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষায় এক্সিলেন্ট গ্রেড পেয়ে এসেছি? তখন আমি আমার ভুল বুঝতে পারলাম। আশপাশের লোকজন কী করতে পারে, লাভলু তা অধিকাংশ সময়ই নির্ভুলভাবে অনুমান করতে পারত।

১৩. রাশিয়ায় থাকাকালে আমাদের হাতে বিদেশি মুদ্রা খুব একটা থাকত না। তবে ইউরোপ ভ্রমণের জন্য আমরা রুবল ব্যবহার করে গোটা ভ্রমণের টিকিট কাটতে পারতাম। ফলে খাওয়া খরচ ও থাকার পয়সা জোগাড় করতে পারলেই হলো। আমরা যা করতাম, তা হলো কত কম খরচে একটি হোটেলে থাকা যায়।

আমি আর লাভলু ঠিক করলাম, ইতালিতে যাব। এর আগে যারা ইতালিতে গিয়েছিল, তাদের থেকে ধারণাও পাওয়া গেল যে রোমের রেলস্টেশন থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে দুই ডলারে একটি হোটেলে থাকা যায়। অবশ্য এর থেকে বেশি তথ্য আমরা পেলাম না। যাহোক, রোম রেলস্টেশনে পৌঁছার পর লাভলু আমাকে অপেক্ষা করতে বলল এই বলে যে সে বাইরে একটু দেখবে ওই হোটেলের খোঁজ পেতে পারে কি না। আমার মনে হলো কাজটি অসম্ভব। রেলস্টেশনকে কেন্দ্র ধরে প্রায় এক কিলোমিটার ব্যাসার্ধ নিয়ে তৈরি বৃত্তের পরিধি বরাবর চলাও সম্ভব হবে না আর আমরা সস্তা হোটেলের খোঁজও পাব না।

অবিশ্বাস্য স্বল্প সময়ে লাভলু হোটেল বের করে ফিরে এল। অসম্পূর্ণ তথ্যে কাজ করতে লাভলুর আগ্রহের জুড়ি নেই, সাফল্যের হারও চমকে দেওয়ার মতো। লাভলুর সাধারণ জ্ঞানের মাত্রা ছিল অসাধারণ—যেকোনো সমস্যার সমাধান বের করতে তার সব ইন্দ্রিয় সমতালে কাজ করত!

১৪. রাশিয়ায় গণপরিবহনের জন্য অটোবাস, ট্রাম (যা বিদ্যুতের সাহায্যে রেললাইনে চলে), ট্রলিবাস (যা বিদ্যুতের সাহায্যে চলে, কিন্তু রেললাইনে নয়) এবং মেট্রো, যা সাধারণত মাটির নিচে চলা রেলগাড়ি, যা খুবই জনপ্রিয় এবং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দ্রুত পৌঁছে দেয়।

একদিন গভীর রাতে বন্ধুদের বাসা থেকে আমরা কয়েকজন ফিরছি ট্রামে করে। রাত একটার মতো বাজে। হঠাৎ এত রাতে ট্রামটি ব্রেক করল, আমরা ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাওয়ার সময় লাভলুর উচ্চারণ—‘শালা নিউটন’। এই গালি দিয়ে লাভলু বোঝাল, নিউটন তার গতির প্রথম সূত্রটি আবিষ্কার না করলে আমাদের এমন ধাক্কা খেতে হতো না! এটা ছিল লাভলুর বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ব্যবহার করে রসাত্মবোধের প্রকাশ!

১৫. লাভলু রাশিয়ায় পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফিরেছে এবং চাকরিপ্রত্যাশী হিসেবে সময় কাটাচ্ছে। তার পড়ালেখার বিষয় শিপ বিল্ডিং ইঞ্জিনিয়ারিং। সুতরাং আবেদনপত্রও কেবল একই বিষয়ে চাকরির জন্য। একবার এ রকম একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে লাভলুর সাক্ষাৎকার। নানা প্রশ্নের উত্তরের পর অফিসের কর্তাব্যক্তি এ রকম একজন বুদ্ধিদীপ্ত প্রকৌশলী পেয়ে খুব খুশি। কর্তাব্যক্তির অত্যন্ত বন্ধুত্বসুলভ প্রশ্ন, ‘আপনি তো একটি ভালো অফার পেলে চলে যাবেন।’ প্রশ্নের মাধ্যমে লাভলুর বন্ধুত্বপূর্ণ ছোট উত্তর, ‘আর আপনি?’

১৬. লাভলু নারায়ণগঞ্জে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। ঢাকায় থাকার ফলে নিয়মিত অফিস করা আর হয়ে উঠে না। প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তির নজরে এল, সদ্য যোগ দেওয়া একজন সহকারী প্রকৌশলী নিয়মিতভাবে অফিসে আসছে না। সে তো রেগেই আগুন এবং লাভলুর সহকর্মীদের বলল, পরদিন অফিসে আসার পরই যেন আবু মুসা খালেদ তার সঙ্গে দেখা করে। লাভলুকে তার সহকর্মীরা এ কথা জানালে সে তো বুঝে গেল, কারণ কী।

পরদিন লাভলু কর্তাব্যক্তির অফিসকক্ষে ঢুকেই একটি প্যাক করা যন্ত্র দেখে তা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেই কর্তা বলে উঠলেন, অনেক দিন যন্ত্রটি এসেছে ব্যবহার করা জানি না বলে পড়ে আছে। লাভলু তাকে জানাল যে সে তার মাস্টার্স করেছে এ বিষয়ে। কর্তাব্যক্তি রাগের কথা ভুলে গিয়ে লাভলুকে অনুরোধ করলেন, কীভাবে এটাকে সচল করা যায়, তার জন্য যেন সে চেষ্টা করে।

লাভলু আবার মাসখানেক অফিসে যায় না। একদিন অফিসে গিয়ে ওই যন্ত্র কীভাবে চালাতে হবে, তার ক্যালিব্রেশন ঠিক করে বুঝিয়ে দিয়ে এল অবশ্য বিনিময়ে অনেক ধন্যবাদও পেল। উল্লেখ্য, লাভলুর মাস্টার্সে সে এমন কোনো যন্ত্র ব্যবহারও করেনি!

১৭. রাশিয়ায় স্কুল থেকে পাস করার সময় অত্যন্ত ভালো ফলাফলকারীদের স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। মশিহুরের রুমমেট এ রকম একজন ছাত্র। তার দাড়ি ছিল বলে আমরা তাকে মৌলভি ডাকতাম। তার সমস্যা হলো শব্দ করে না পড়লে তার পড়া হয় না। চারজনের রুমে শব্দ করার সুযোগ নেই। ক্লাস শেষে একমাত্র ক্যাফেটেরিয়ায় ক্ষুধার্ত হাজার দুয়েক ছাত্র লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে খাবারের অপেক্ষায় থাকে।

এর মধ্যে লাভলু খেয়াল করল, ক্ষুধার্ত মশিহুর নেই, নিশ্চয়ই খাবার থেকে আকর্ষণীয় কিছুর সন্ধান পেয়েছে। সে একদিন মশিহুরের পেছনে ধাওয়া করল। মশিহুর নিজের রুমে নিজের বিছানায় শুয়ে আছে। মৌলভি পড়ছে, মশিহুরের মুখস্থ হচ্ছে। সে মশিহুরকে ডেকে বলল, এই সুযোগ তাকে না দিলে সে মৌলভিকে ঘটনাটি বলে দেবে। লাভলুরও অনুমান একলব্যের নিশানার মতো নিখুঁত।

লাভলু নশ্বর পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। আরও অনেক আনন্দ দিয়ে আমাদের জীবন রঙিন করতে পারত। তার জীবনাবসানে তা আর সম্ভব হয়নি। তবে আমরা যারা লাভলুকে কাছ থেকে দেখেছি, তার বুদ্ধিদীপ্ত ঘটনাগুলো এখনো আমাদের একই রকম আনন্দ দেয়। অন্য জগতে নিশ্চয়ই লাভলুর চির সজাগ মস্তিষ্ক বসে নেই, অনেক আনন্দের জন্ম দিচ্ছে!

  • মোহাম্মদ কায়কোবাদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক