যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে কথিত আইএসআইএল বা আইএস লক্ষ্যবস্তুতে যে হামলা চালিয়েছে, ওয়াশিংটনে তা একটি দৃঢ় সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সমর্থকদের কাছে এ নজিরবিহীন অভিযান সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে কঠোর অবস্থানের বার্তা দিয়েছে। একই সঙ্গে ট্রাম্প যে নাইজেরিয়ায় একটি কথিত ‘খ্রিষ্টান গণহত্যা’ চলছে বলে দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের চেষ্টাও এতে দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু এ সামরিক তৎপরতার আড়ালে রয়েছে এক কঠিন বাস্তবতা। এ ধরনের বোমা হামলা নাইজেরিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবে না বা সংঘাতপীড়িত দেশটিকে স্থিতিশীল করতেও সহায়তা করবে না; বরং এসব হামলা সংঘাতের প্রকৃত রূপকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার ঝুঁকি তৈরি করছে এবং সহিংসতার পেছনে থাকা গভীর কাঠামোগত সংকট থেকে মনোযোগ সরিয়ে দিচ্ছে।
এ হামলার প্রথম সমস্যা হলো এর কৌশলগত যুক্তির অভাব। প্রাথমিক হামলা চালানো হয় উত্তর-পশ্চিম নাইজেরিয়ার সোকোতো অঞ্চলে, যেখানে এক দশক ধরে অস্থিরতা চলছে। তবে এ সহিংসতার মূল কারণ আইএসআইএলের সঙ্গে যুক্ত কোনো আদর্শিক বিদ্রোহ নয় এবং সেখানে আইএসআইএল-সংযুক্ত কোনো গোষ্ঠীর সক্রিয় উপস্থিতির প্রমাণও নেই। এ অঞ্চলের নিরাপত্তাসংকট মূলত ডাকাতি, গ্রামীণ অর্থনীতির ভেঙে পড়া অবস্থা এবং জমি নিয়ে প্রতিযোগিতার ফল।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে হতাহত ব্যক্তিদের বিষয়ে স্বচ্ছ তথ্য না দেওয়ায় বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপ নিয়ে আগে থেকেই সন্দিহান জনগোষ্ঠীর মধ্যে অবিশ্বাস আরও বাড়তে পারে। প্রতীকী বিষয়ও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। হামলাটি চালানো হয়েছে বড়দিনে, যা আবেগগত ও রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন।
এখানে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বিচ্ছিন্ন এবং তাদের প্রধান উদ্দেশ্য লাভ করা। বড়দিনের হামলাগুলো সম্ভবত লাকুরাওয়া নামের তুলনামূলক নতুন একটি আদর্শিক সশস্ত্র গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে। তবে এ গোষ্ঠীর প্রকৃত পরিচয় এবং আইএসআইএলের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
উত্তর নাইজেরিয়ায় যেসব আদর্শিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর সবচেয়ে শক্ত অবস্থান রয়েছে, তারা হলো বোকো হারাম এবং আইএসআইএল-সংযুক্ত ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রদেশ বা আইএসডব্লিউএপি। এসব গোষ্ঠীর প্রধান কার্যক্রম সোকোতো থেকে শত শত কিলোমিটার দূরে—নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বর্নো, ইয়োবে ও আদামাওয়া রাজ্যে কেন্দ্রীভূত, যেখানে বিদ্রোহের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।
তাই প্রশ্ন ওঠে, কেন প্রথমে উত্তর-পশ্চিমে হামলা চালানো হলো। এর কোনো স্পষ্ট যুক্তি দেখা যায় না। এর পাশাপাশি হতাহতের সংখ্যা নিয়ে অনিশ্চয়তাও গভীর উদ্বেগের কারণ। এখনো পর্যন্ত কোনো নির্ভরযোগ্য সরকারি তথ্য পাওয়া যায়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কিছু অ্যাকাউন্ট দাবি করছে, এতে কোনো মানুষের প্রাণহানি হয়নি এবং বোমাগুলো খালি লক্ষ্যবস্তুতে পড়েছে।
নাইজেরিয়ার সংবাদমাধ্যম অ্যারাইজ টিভি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে স্থানীয় ব্যক্তিদের বরাতে জানিয়েছে, অন্তত একটি হামলা এমন এলাকায় হয়েছে, যেখানে আগে কখনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। তারা আরও জানায়, বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে কি না, তাসহ হামলার পূর্ণ প্রভাব এখনো নির্ধারণ করা যায়নি।
অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু ছবি ছড়ানো হয়েছে, যেখানে বেসামরিক হতাহতের অভিযোগ করা হয়েছে। তবে এসব দাবির সত্যতা এখনো যাচাই হয়নি। এমন এক পরিস্থিতিতে, যেখানে সশস্ত্র সংঘাতের পাশাপাশি তথ্যযুদ্ধও চলছে, সেখানে গুজব অনেক সময় সত্যের চেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে হতাহত ব্যক্তিদের বিষয়ে স্বচ্ছ তথ্য না দেওয়ায় বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপ নিয়ে আগে থেকেই সন্দিহান জনগোষ্ঠীর মধ্যে অবিশ্বাস আরও বাড়তে পারে। প্রতীকী বিষয়ও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। হামলাটি চালানো হয়েছে বড়দিনে, যা আবেগগত ও রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন।
উত্তর নাইজেরিয়ার অনেক মুসলমানের কাছে এ সময় নির্বাচন এমনভাবে ব্যাখ্যা হতে পারে যে এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর পশ্চিমা ‘ধর্মযুদ্ধের’ ধারণাকে সমর্থন করছে। এর চেয়েও বেশি সংবেদনশীল হলো হামলার স্থান সোকোতো। ঐতিহাসিকভাবে এটি উনিশ শতকের সোকোতো খেলাফতের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র, যা নাইজেরিয়ার মুসলমানদের কাছে ইসলামি কর্তৃত্ব ও বিস্তারের এক সম্মানিত প্রতীক।
এমন একটি প্রতীকী কেন্দ্রে বোমা হামলা যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব উসকে দিতে পারে, ধর্মীয় অবিশ্বাস আরও গভীর করতে পারে এবং কট্টর প্রচারকারীদের জন্য সহজে কাজে লাগানোর মতো সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে।
কথিত আইএসআইএলের প্রভাব দুর্বল করার বদলে এসব হামলা উল্টোভাবে নতুন সদস্য সংগ্রহে গতি বাড়াতে পারে এবং ক্ষোভের বয়ানকে আরও জোরালো করে তুলতে পারে।
যদি আকাশপথে হামলা নাইজেরিয়ার নিরাপত্তাসংকটের সমাধান না হয়, তাহলে সমাধান কী? এর উত্তর বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপে নেই। নাইজেরিয়ার সংঘাত আসলে গভীর শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতার লক্ষণ। দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থা, দুর্নীতি এবং গ্রামীণ এলাকায় রাষ্ট্রের অনুপস্থিতিই এ সংকটের মূল কারণ।
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ডাকাত দল সক্রিয়, সেখানে মানুষ সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে সমঝোতায় যায় তাদের প্রতি সমর্থনের কারণে নয়; বরং রাষ্ট্র নিরাপত্তা ও মৌলিক সেবা দিতে ব্যর্থ হওয়ায়। আবার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, যেখানে বোকো হারামের উত্থান, সেখানে দীর্ঘদিনের সরকারি অবহেলা, কঠোর নিরাপত্তাকৌশল এবং অর্থনৈতিক বঞ্চনা বিদ্রোহের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। তাই টেকসই নিরাপত্তাব্যবস্থা হতে হবে বহুস্তরভিত্তিক। এতে কমিউনিটিভিত্তিক পুলিশিংয়ে বিনিয়োগ, সংলাপ এবং উগ্রবাদ থেকে ফিরে আসার পথ তৈরি করা জরুরি।
রাষ্ট্রের উপস্থিতি এমন হতে হবে, যা মানুষকে শাস্তি দেয় না; বরং সুরক্ষা দেয়। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহকে অগ্রাধিকার দেওয়া, স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে শক্তিশালী করা এবং নাগরিক ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আস্থা পুনর্গঠন করাও এর অংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের এসব হামলা হয়তো সংবাদ শিরোনাম তৈরি করবে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ শ্রোতাদের সন্তুষ্ট করবে। কিন্তু নাইজেরিয়ার বাস্তবতায় এগুলো কট্টর প্রচারণাকে আরও শক্তিশালী করা এবং ক্ষোভ বাড়ানো ছাড়া তেমন কিছুই করবে না।
নাইজেরিয়ার মানুষের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বোমাবর্ষণের প্রয়োজন নেই। তাদের প্রয়োজন নিজস্ব সংস্কার। স্থানীয় পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা, যাতে আস্থা পুনর্গঠন হয়, জীবিকা ফিরে আসে এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হয়। এর চেয়ে কম কিছুই হলে তা হবে কেবল মনোযোগ ঘোরানোর চেষ্টা।
• ফেমি ওউওলাদে, আইন ইতিহাসবিদ এবং শেফিল্ড হ্যালাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সহযোগী
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত