সমস্যাটা ঠিক কোথায়? আমরা যারা সামান্য আঘাতে আহত হই, ভেঙে পড়ি, ভাবতে শুরু করি, পৃথিবী থেকে পালিয়ে গেলেই মুক্তি। জীবন সম্বন্ধে আমরা কি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল? পালিয়ে গেলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যায়! নাকি এ ভাবনা অনেকটাই আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর। তারপরও একজন ব্যক্তি চিরদিন কি কেবল নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন। নাকি সময়ের সঙ্গে শরীরে, মানসে বড় হওয়ার মতো অনেকের হয়ে ওঠেন। অনিমেষ বাবুর (ছদ্মনাম) গল্প থেকেই জানা যাক।
ভদ্রলোকের সঙ্গে রেলস্টেশনের এক কফির দোকানে আলাপ। সেদিন ঝম ঝম করে বৃষ্টি হচ্ছিল। এক পরিচিতকে রিসিভ করতে গিয়েছিলাম। দাঁড়িয়ে আছি, সাইরেন বাজিয়ে ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকল। বৃষ্টির মধ্যেই যাত্রীরা একে একে নামলেন, উঠলেন।
ট্রেন চলতে শুরু করল। পরিচিত আসেননি, পরের ট্রেনে আসছেন। লম্বা সময় কাটাতে হবে। দক্ষিণ দিকের কফির দোকানের সামনে কাঠের বেঞ্চের ওপর গিয়ে বসি। হঠাৎ চোখে পড়ে, বেঞ্চের এক প্রান্তে বসে মানুষটা চোখের জল ফেলছেন। তার কাছে এগিয়ে যাই। কথায় কথায় জানতে পারি, বছর কয়েক আগে ভদ্রলোকের একমাত্র ছেলে আত্মহত্যা করে। শোকে পর্যুদস্ত হয়ে তার কিছুদিন বাদেই স্ত্রীও মারা যায়।
ভদ্রলোক চাকরি করতেন। এখন রিটায়ারমেন্টে। বয়স মধ্যসত্তর। সহায়-সম্বল, সম্পত্তি সব আছে, কিন্তু দেখার কেউ নেই। ছেলের আত্মহত্যা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হুতাশের স্বরে বলেন, ‘চাকরি হয় না, হয় না করতে করতে...আমাকে নিঃস্ব করে বাবাটা নাই হয়ে গেল।’ কথায় কথায় আরও জানতে পারি, ছেলে মারা যাওয়ার কয়েক দিনের মাথায় একটি প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরির অফার লেটার আসে।
পদক্ষেপ হিসেবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে সহজলভ্য করতে হবে। শিক্ষাস্তরের প্রতিটি পর্যায়ে অনুপ্রেরণামূলক পাঠ অন্তর্ভুক্তির সঙ্গে সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে মানুষকে আগ্রহী করতে সভা, সেমিনার, কর্মশালা ও আলোচনার মধ্য দিয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। পরিবার, কর্মক্ষেত্র থেকে পদচারণের প্রতিটি পর্যায়ে একে অন্যের প্রতি যত্নবান হতে হবে। একে অপরের পাশে থাকতে হবে। পাশাপাশি অনুপ্রেরণামূলক তথ্যচিত্র তৈরির মধ্য দিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়।
উল্লিখিত ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। চাকরি না হওয়া, পরীক্ষায় ফলাফল খারাপ করা, প্রিয় মানুষের প্রত্যাখ্যানসহ তুচ্ছ তুচ্ছ কারণে তাজা তাজা জীবন বলি হয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, পরীক্ষায় ফলাফল খারাপ করা, চাকরি না হওয়া কিংবা প্রিয়জনের প্রত্যাখ্যান কি তুচ্ছ ঘটনা? উত্তর নিতান্তই সরল, জীবনের চেয়ে বড় কিছু নেই, জীবনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু হতে পারে না।
পরীক্ষায় কেউ ভালো করবে, কেউ খারাপ করবে, এটিই স্বীকৃত। তার জন্য আত্মহত্যা করতে হবে কেন? একবার ভালো না হলে পরবর্তী সময়ে চেষ্টা করে ভালো করার সুযোগ থাকে। তা ছাড়া প্রত্যেককে সব বিষয়ে সেরা হতে হবে; এ প্রবণতাতেই-বা কেন বুঁদ হয়ে যাচ্ছি। এরও বড় বিষয়, একটি পরাজয়, একটি ব্যর্থতা দিয়ে জীবনকে বিচার করার প্রবণতাই-বা কেন! পরাজয় কিংবা ব্যর্থতা দিয়ে বিচার করার মতো জীবন তো ক্ষুদ্র কোনো বিষয় নয়। জীবন ভোরের সূর্যের মতো দীপ্তিমান, যেখানে প্রতিটি দিন নতুন নতুন সম্ভাবনা নিয়ে উপস্থিত হয়। কোনো না কোনো লড়াই প্রতিদিনই লড়তে হয়। নিরবচ্ছিন্নভাবে কারও পক্ষেই বিজয়ী হওয়া সম্ভব নয়। তারপরও চারপাশে হতাশার বিষবাষ্প কেন?
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে দ্বিধা নেই যে শিক্ষার্থীর যখন পরীক্ষায় ফলাফল খারাপ হয় কিংবা কোনো ব্যক্তি যখন ব্যর্থতা বা সমস্যায় পর্যুদস্ত হয়, অধিকাংশের ক্ষেত্রে প্রথম আঘাত আসে পরিবার ও প্রিয়জন থেকে। অথচ দৃঢ়তম বেদনার দিনে তাদেরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। পাশাপাশি প্রয়োজন সেই মানুষকে, এমনকি সেই বন্ধুকেও, যার ওপর তার অগাধ বিশ্বাস।
সবকিছুতেই এত নেতিবাচকতা কেন? প্রতিবেশী, সহকর্মী, স্বল্পপরিচিত-পরিচিত, যে কারও দুর্দশার দিনে আমরা কি পাশে গিয়ে দাঁড়াই? কাঁধে হাত রেখে বলি, সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কবে, কবে আমাদের বোধোদয় হবে? আমরা একে অপরকে বুঝতে চেষ্টা করব। আনন্দে আনন্দিত আর দুঃখে সমব্যথী হব। কবে বুঝতে শিখব, চেহারায় মানুষ যেমন ভিন্ন, ভিন্ন; জীবনের গতিপথও প্রত্যেকের তেমন আলাদা আলাদা। এক পথে, এক কাজে, এক ধাঁচে সবাই সফল হতে পারে না, হবে না। তারপরও চাকরি নিয়ে, ফলাফল নিয়ে এত হইচই কেন? একটি প্রতিযোগিতার কথা বিবেচনা করা যাক।
যেখানে দুই হাজার প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করবে, কিন্তু উপহার থাকবে তিনজনের জন্য। ৩ জন বিজয়ী হবে আর বাকি ১ হাজার ৯৯৭ জন বাদ পড়বে। গভীরভাবে ভাবলে প্রশ্ন জাগে, চাকরিসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোও কি এরূপ নয়! এর মানে ভালো ফলের জন্য, চাকরির জন্য আমরা কি চেষ্টা করব না? নিশ্চয়ই করব। শুধু হতাশ হব না। একটি চাকরি, একটি ফলাফল, একটি প্রত্যাখ্যান জীবনের সবকিছু নয়। নদীর মতো প্রবহমান জীবনে কখনো ভাটা, কখনো জোয়ার আবার কখনোবা স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করে। জীবন কখনো ব্যর্থ হয় না। প্রকৃত সত্য এটিই, প্রত্যেকে নিজের নিজের জায়গায় বিজয়ী। তাই অন্যের সঙ্গে তুলনা করে জীবনের সুখ বিসর্জন দেওয়া বোকামি।
তারপরও বিষণ্নতা, হতাশা বোধ করলে অপেক্ষা করা যাবে না। শারীরিকভাবে অসুস্থ হলে আমরা যেমন ডাক্তারের শরণাপন্ন হই। মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত বোধ করলেও দ্রুততার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে হবে। দ্য ডেইলি স্টার বাংলার ‘৮ মাসে ৩৬১ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা: আঁচল ফাউন্ডেশন’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ৩৬১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে, যার মধ্যে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থী রয়েছে। দিন দিন আত্মহত্যা প্রবণতা ভয়ানক হয়ে উঠছে। কেবল শিক্ষার্থীই নয়, বিভিন্ন পেশার, বিভিন্ন স্তরের মানুষ আত্মহত্যার পথে ধাবিত হচ্ছে। তাই কেবল হাহুতাশের ভঙ্গিতে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আর দুঃখ করে নয়।
এ ভয়াবহ সমস্যা মোকাবিলা করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। পদক্ষেপ হিসেবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে সহজলভ্য করতে হবে। শিক্ষাস্তরের প্রতিটি পর্যায়ে অনুপ্রেরণামূলক পাঠ অন্তর্ভুক্তির সঙ্গে সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে মানুষকে আগ্রহী করতে সভা, সেমিনার, কর্মশালা ও আলোচনার মধ্য দিয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। পরিবার, কর্মক্ষেত্র থেকে পদচারণের প্রতিটি পর্যায়ে একে অন্যের প্রতি যত্নবান হতে হবে। একে অপরের পাশে থাকতে হবে। পাশাপাশি অনুপ্রেরণামূলক তথ্যচিত্র তৈরির মধ্য দিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়।
সর্বোপরি জীবন সুন্দর: জীবন থেকে পালিয়ে নয়, যাপনের মধ্য দিয়েই জীবন মহিমান্বিত হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, জীবনের জন্যই সবকিছু, কোনো কিছুর জন্যই জীবন নয়।
সৌমেন্দ্র গোস্বামী কবি ও লেখক