শিক্ষার উদ্দেশ্যে সফর গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত

ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম হজ। হজ অর্থ সফর। ওমরাহ অর্থ ভ্রমণ। ভ্রমণের আরবি হলো সফর, সায়ের, রিহলাত ইত্যাদি। যিনি সফর করেন, তাঁকে বলা হয় মুসাফির বা পথিক। 

আনন্দভ্রমণ বা শিক্ষাসফরের বিশেষ উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহ তাআলার সৃষ্টিরহস্য অবলোকন, জ্ঞানার্জন, তাঁর কুদরত ও শক্তির প্রতি অনুগত হওয়া। কোরআন মজিদে রয়েছে, ‘তারা দেশ ভ্রমণ করে না? তা হলে তারা জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন হৃদয় ও শ্রুতিশক্তিসম্পন্ন শ্রবণের অধিকারী হতে পারত। বস্তুত চক্ষু তো অন্ধ নয়, বরং অন্ধ হচ্ছে বক্ষস্থিত হৃদয়।’ (সুরা-২২ হজ, আয়াত: ৪৬) ‘বলো, “তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং অনুধাবন করো, কীভাবে তিনি সৃষ্টির সূচনা করেছেন? অতঃপর আল্লাহ সৃজন করবেন পরবর্তী সৃষ্টি। আল্লাহ তো সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।”’ (সুরা-২৯ আনকাবুত, আয়াত: ২০)

প্রাকৃতিক পরিবেশ, নদ-নদী, খাল-বিল, বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, রাস্তাঘাট, যানবাহন ও পরিবহন, যাতায়াতব্যবস্থা আল্লাহর কুদরতেরই অংশ। কোরআন মজিদের বর্ণনা, ‘তাদের ও যেসব জনপদের প্রতি আমি অনুগ্রহ করেছিলাম, যেগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে বহু জনপদ স্থাপন করেছিলাম এবং ওই সব জনপদে ভ্রমণের যথাযথ ব্যবস্থা করেছিলাম এবং তাদের বলেছিলাম, “তোমরা এসব জনপদে নিরাপদে ভ্রমণ করো দিবস ও রজনীতে।”’ (সুরা-৩৪ সাবা, আয়াত: ১৮)

শীত, বসন্ত ও গ্রীষ্মকাল ভ্রমণের আদর্শ সময়। কোরআন হাকিমের বর্ণনায়, ‘কুরাইশদের অনুরাগ, তাদের আসক্তি শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন ভ্রমণে। সুতরাং তাদের উচিত এই (কাবা) ঘরের প্রভুর ইবাদত করা। যিনি ক্ষুধায় তাদের অন্ন দিয়েছেন, ভয়ে দিয়েছেন নিরাপত্তা।’ (সুরা-১০৬ কুরাইশ, আয়াত: ১-৪)

ইসলামের একটি বিধিবদ্ধ ইবাদত ভ্রমণ বা সফর। সফরের রয়েছে বিশেষ কিছু বিধিবিধান। ইসলামি শরিয়তে ফিকহি পরিভাষায় সফর হলো আপন বাসস্থান থেকে বা কর্মস্থল থেকে ৪৮ মাইল বা ৭০ কিলোমিটার দূরত্বে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নিজ মহল্লা বা গ্রাম থেকে বের হওয়া। গন্তব্যে পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত সফর অবস্থা বহাল থাকে। সফর বা ভ্রমণকারীকে মুসাফির বলা হয়। গন্তব্য যদি নিজ বাড়ি বা কর্মক্ষেত্র হয়, তবে সেখানে পৌঁছার পর আর সফরকারী মুসাফির থাকবেন না। আর গন্তব্য যদি নিজ বাড়ি বা কর্মক্ষেত্র না হয় এবং সেখানে অন্তত ১৫ দিবস রজনী থাকার নিয়ত বা ইচ্ছা না থাকে, তাহলে সফর অবস্থা বহাল থাকবে।

সফরে থাকা অবস্থায় দোয়া কবুল হয়। চার রাকাতবিশিষ্ট ফরজ নামাজ সফরকালীন অবস্থায় কসর অর্থাৎ দুই রাকাত পড়তে হয় এবং সুন্নত নামাজ নফলের পর্যায়ভুক্ত হয়। নামাজ কসর বা সংক্ষিপ্ত হওয়ার বিধানটি একাকী নামাজ পড়া মুসল্লির জন্য প্রযোজ্য। কোনো মুসাফির ব্যক্তি ইমামের পেছনে মুক্তাদি হয়ে নামাজ পড়লে ইমাম যত রাকাত পড়বেন, তত রাকাতই পড়তে হবে। আর মুসাফির ইমামের পেছনে যদি মুকিম বা স্থানীয় মুক্তাদি থাকেন, তাঁরা ইমামের দুই রাকাতের পর সালাম ফেরানোর পর অবশিষ্ট নামাজ মাসবুকের মতো আদায় করবেন। জটিলতা এড়ানোর স্বার্থে মুকিম ব্যক্তিদের মধ্যে ইমামতি করার যোগ্য লোক থাকলে মুসাফির ইমাম না হওয়াই শ্রেয়। 

সফর অবস্থায় জুমা ও ঈদের নামাজ এবং কোরবানি জরুরি নয়; তবে সুযোগ থাকলে আদায় করা উত্তম। জুমার নামাজের পরিবর্তে জোহরের নামাজ পড়লেই চলবে, ঈদের নামাজের বিকল্প প্রয়োজন হবে না। মুসাফির প্রয়োজনে ফরজ রোজা পরবর্তীকালে কাজা রাখতে পারবেন। সফর অবস্থায় রাখলেও তা আদায় হয়ে যাবে। 

মুকিম বা স্থায়ী নিবাসে থাকা অবস্থায় মোজার ওপর মাসেহ করার সময়সীমা যেখানে ১ দিন বা ২৪ ঘণ্টা; সেখানে সফর অবস্থায় মোজার ওপর মাসেহ করার সময়সীমা ৩ দিন তথা ৭২ ঘণ্টা। 

সফর একটি আনন্দময় ইবাদত, সফর জ্ঞান-প্রজ্ঞার উৎস ও অভিজ্ঞতার বাহন। সফর যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতময় ইবাদত, এই বিষয়ে জানা থাকলে আমরা আনন্দভ্রমণ বা শিক্ষাসফরে জাগতিক আনন্দ উপভোগের পাশাপাশি পরকালে পুণ্য লাভে ধন্য হব।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]