অনন্য নেলসন ম্যান্ডেলা

নেলসন ম্যান্ডেলা
নেলসন ম্যান্ডেলা

সিডও সনদের সঙ্গে নেলসন ম্যান্ডেলার সম্পৃক্ততার একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা রয়েছে, যাতে আমার ছিল অনুঘটকের ভূমিকা। জাতিসংঘের নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ, যা সংক্ষেপে ‘সিডও’ সনদ নামে পরিচিত, এযাবৎ ১৮৭টি দেশ এটিকে অনুসমর্থন করেছে এবং যে সনদ বাস্তবায়নে দক্ষিণ আফ্রিকা উল্লেখ্য অগ্রগামী দেশ হিসেবে পরিচিত। প্রথাগতভাবে অধিকাংশ সনদ গ্রহণকারী দেশ প্রথম পর্যায়ে সনদটিতে শুধু স্বাক্ষর করে থাকে, যা জাতিসংঘের পরিভাষায় নীতিগত অনুমোদনকে বোঝায় এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আংশিক সংরক্ষণসহ বা বিনা সংরক্ষণে সনদে অনুসমর্থন প্রদান করে থাকে এবং তখনই সনদের ধারাসমূহ কার্যকর ও বাস্তবায়ন করা রাষ্ট্রপক্ষের চুক্তিবদ্ধ দায় হিসেবে বিবেচিত হয়।

উল্লেখ্য, বেশ কিছু দেশ প্রাথমিক স্বাক্ষর না দিয়ে একবারেই সনদে অনুসমর্থন প্রদান করে থাকে, বাংলাদেশ যার মধ্যে একটি। দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে সিডও সনদে নীতিগতভাবে স্বাক্ষর করে এবং প্রায় তিন বছর পর ১৯৯৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর সনদ অনুসমর্থন করে কার্যকর করার দায়ভার নেয়।
স্মরণ করা যেতে পারে, বৈশ্বিক পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নে ১৯৯৫ সালের ৪ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন ছিল এযাবৎ অনুষ্ঠিত বৃহত্তম বিশ্ব সম্মেলন, যাতে ১৮৯ দেশের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় ১৭ হাজার প্রতিনিধি যোগদান করেন। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ওই সম্মেলনের মহাসচিব হিসেবে মিদ গারট্রুড মঙ্গেলাকে মূল দায়িত্ব দেওয়া হলেও জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বুট্রোস বুট্রোস ঘালি সিডও কমিটির সঙ্গে একটি সভায় আশু সম্মেলনের বিভিন্ন দিক আলোচনা করে সিডও কমিটিকে বিশেষ দায়িত্ব প্রদান করেন, সম্মেলনটি যাতে প্রকৃত অর্থে বৈশ্বিক পর্যায়ে সর্বস্তরের ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর নারীর অংশগ্রহণে সামুদয়িক রূপ লাভ করে এবং নারীজীবনের বহুমাত্রিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়।

তখন সিডও কমিটির চেয়ারপারসন ছিলেন ইতালির বিখ্যাত বর্ষীয়ান নারী আন্দোলনকর্মী ইভাস্কা কর্টি এবং আমি প্রথম মেয়াদে নির্বাচিত কমিটির সদস্য। আলোচনায় উঠে আসে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে একটি শক্তিশালী প্রতিনিধিদলের সম্মেলনে যোগদান নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা, যাতে করে বিশেষভাবে বর্ণবাদের শিকার নারীর সমস্যাসমূহ চিহ্নিতকরণ এবং তা মোকাবিলার বিষয়সমূহ আলোচ্যসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পায়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিডও কমিটি দক্ষিণ আফ্রিকার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মিশন-প্রধানকে একটি চিঠি লেখে। কিন্তু প্রতিনিধি কমিটিকে অবহিত করেন, বর্তমানে দেশটি স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রশাসনিক, পুনর্বাসন ও আন্তরাষ্ট্রীয় বিভিন্ন জরুরি ইস্যু নিয়ে এত ব্যস্ত যে তাদের পক্ষে সিডও সনদ অনুসমর্থনের জন্য তা পার্লামেন্টে উত্থাপন সম্ভব নয় এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে অফিশিয়াল প্রতিনিধিদল পাঠানোর দায়বদ্ধতা নেই।

দক্ষিণ আফ্রিকার নিউইয়র্ক মিশন থেকে প্রস্তাব নাকচ হওয়ার পর ইভাস্কা কর্টি আমাকে বললেন, আমার স্বামী হাবিব উল্লাহ খান যেহেতু দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত, সেহেতু তাঁর মাধ্যমে আমরা প্রেসিডেন্ট ম্যান্ডেলাকে এ ব্যাপারে আবেদন করতে পারি কি না। ইভাস্কা কর্টি আমাকে সিডও কমিটির বিশেষ ‘দূত’ নিয়োগে প্রেসিডেন্ট ম্যান্ডেলার উদ্দেশে একটি চিঠি দিলেন, যাতে ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরের আগে সিডও সনদে অনুসমর্থন প্রদান ও চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষ থেকে একটি শক্তিশালী প্রতিনিধিদল প্রেরণের আবেদন জানানো হয়।

আমি নিউইয়র্ক থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় এসে বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ পাহাদের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করলাম, যাতে তাঁর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ম্যান্ডেলাকে সিডও সনদ অনুসমর্থনের ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করা যায়। দুই দিনের মধ্যেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে সময় দিলেন। সিডিও কমিটির পক্ষ থেকে আমি তাঁকে আমাদের অনুরোধপত্র হস্তান্তর করলাম এবং তিনি আমাকে কথা দিলেন, যত দ্রুত সম্ভব তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করে তাঁর সিদ্ধান্ত আমাকে জানাবেন। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানালেন, সিডও কমিটির আবেদন প্রেসিডেন্ট ম্যান্ডেলা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন এবং সনদ স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে তিনি একটি শক্তিশালী প্রতিনিধিদল বেইজিং সম্মেলনে পাঠোনোর নির্দেশ দেবেন। বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিডও কমিটিকে চিঠির মাধ্যমে জানাল। প্রকৃতই দক্ষিণ আফ্রিকার একটি শক্তিশালী দল বেইজিংয়ে যোগ দেয়। পরবর্তী সময়ে ওই বছরেরই ১৫ ডিসেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকা সিডও সনদে অনুসমর্থন প্রদান করে।

সুদীর্ঘ বর্ণবাদ, জাতিগত বিভক্তি, দারিদ্র্য ও অনুন্নয়নের সমস্যা মোকাবিলায় সরকারের কর্মকাণ্ড ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ম্যান্ডেলা সিডও কমিটির অনুরোধ রক্ষার জন্য কমিটি তাঁকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানায়। কিছুদিন পর একটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা হওয়ায় আমি যখন তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম, তখন ভীষণ আনন্দিত বোধ করলাম যে তিনি আমাকে চিনতে পেরেছেন। তাঁর ছিল অসাধারণ স্মৃতিশক্তি, সেই সঙ্গে বাংলাদেশিদের জন্য একধরনের প্রশংসিত মূল্যায়ন। এর মূল কারণ, তখন দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারি হাসপাতালগুলোয় তিন শর অধিক বাংলাদেশি চিকিৎসক কর্মরত ছিলেন, যাঁদের অধিকাংশের পোস্টিং ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রামাঞ্চলে।

বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে যখন আমার স্বামীর পরিচয়পত্র প্রদান অনুষ্ঠানে যোগ দিই, তখন প্রথাগত আনুষ্ঠানিকতা পেরিয়ে তিনি রাষ্ট্রদূতকে ‘বন্ধু’ বলে সম্বোধন করে বলেছিলেন, তাঁর নিজের গ্রামের হাসপাতালেও একজন বাংলাদেশি চিকিৎসক কর্মরত, যিনি গ্রামবাসীর কাছে প্রিয় মানুষ। ম্যান্ডেলা যেমন তিনি নিজের দেশবাসীর, তেমনি বাইরের মানুষকে অবলীলায় আপন করে নিতে পারতেন। প্রথাগতভাবে কূটনীতিকদের ‘এক্সেলেন্সি’র পরিবর্তে তিনি ‘মাই ফ্রেন্ড’ হিসেবে সম্বোধন করতেন।

১৯৯৭ সালে যখন তিনি রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ঢাকায় আসেন, তখন বঙ্গভবনে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আমাকে চিনতে পারবেন কি না ভেবে সংকুচিত চিত্তে ভিড় ঠেলে এগোচ্ছি। তিনি হঠাৎ আমার হাত ধরে বললেন, ‘কেমন আছেন, আমার বন্ধু কোথায়?’ আমি তখন ভিড় ঠেলে হাবিবুল্লাহ খানকে ডেকে আনলে তিনি এত আন্তরিকতার সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন, যা শুধু তাঁর মতো একজন বিশাল হূদয়ের বিশ্বমানবতাবোধসম্পন্ন মানুষের পক্ষেই সম্ভব; যিনি একই সঙ্গে অন্যায় ও মানবিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আপসহীন এক যোদ্ধা, আবার ব্যক্তিপর্যায়ে প্রত্যেক মানুষকে গভীর আবেগে ও আন্তরিকতায় সিক্ত করতে পারেন।

আমরা গর্বিত যে তিনি তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনী লং ওয়াক টু ফ্রিডম বইটিতে ‘টু হাবিব উল্লাহ খান, কমপ্লিমেন্ট অ্যান্ড বেস্ট উইমেন টু অ্যা হাইলি ইমপ্রেসিভ ডিপ্লোম্যাট নেলসন ম্যান্ডেলা, ২৩.৫.৯৫’ লিখে উপহার দিয়েছেন।
সালমা খান: অর্থনীতিবিদ, নারীনেত্রী।