ইশকুল থেকে এত ফুল ঝরে যাবে?

টিকা, হাসপাতাল, অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর—এসবের ব্যবস্থা করলে হয়তো করোনার হাত থেকে জান বাঁচবে। কিন্তু শিক্ষা? তার যে মরণদশা চলছে, তার কী হবে? বিশেষ করে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষা তার চিরায়ত ছন্দ হারিয়ে এখন গৃহবন্দী হয়েছে।
আমার সাত বছরের শিশুপুত্র মাস ছয়েক আগেও প্রায় প্রতিদিনই ‘ইক্কুল! ইক্কুল দাবো’ বলে ইশকুলে যাওয়ার যে দাবি তুলত, এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে। অর্থাৎ স্কুল নামের যে বিদ্যায়তনের কাঠামো তার মনোজগতে ছিল, তা এত দিনে বিলীয়মান অবস্থায় চলে এসেছে।

চিত্রটি উদ্বেগজনক। বহু বছরের চেষ্টায় ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কার্যক্রম যতটুকু এগিয়ে নেওয়া গিয়েছিল, গত দেড় বছরে তা শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন শিক্ষাকে ‘সবার জন্য’ বলা কঠিন হয়ে পড়েছে। শিক্ষা আবার আগের মতো ‘অধিকারভেদ’-এর খাতায় চলে গেছে।

যার স্মার্টফোন আছে, ইন্টারনেট সংযোগের খরচ গোনার মতো পয়সা আছে, সর্বোপরি ইন্টারনেট সংযুক্ত এলাকায় যে শিশুর বাস, কার্যত তারই আজ শিক্ষার অধিকার আছে। ইন্টারনেটের নেটওয়ার্কের দুর্বলতা এখন শিক্ষার দুর্বলতা হয়ে দেখা দিয়েছে। ডিজিটাল সুবিধায় তারতম্যের জন্য গ্রাম ও শহর, সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের বৈষম্য প্রকট হয়েছে। এমনকি একই স্কুলের সহপাঠীদের শিক্ষালাভে হেরফের হচ্ছে।

‘শিক্ষার মাধ্যমে সাম্য’ এই ধারণা থেকে মহামারি যদি দেশকে বিচ্যুত করে, তার ফল হবে সুদূরপ্রসারী। এর খেসারত গোটা জাতিকে দিতে হবে। শৈশবে শিক্ষালাভের সুযোগের কাঠামোগত বৈষম্য বহু ছেলেমেয়ের জীবনের কক্ষপথটিকেই ঘুরিয়ে ফেলবে। ক্রমবর্ধমান অসাম্য তাতে আরও বাড়বে।

সেভ দ্য চিলড্রেন বলছে, এই মহামারির পরে প্রায় এক কোটি শিশু আর স্কুলে ফিরে যেতে পারবে না। শিক্ষা তহবিল কাটছাঁট ও দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার কারণে এই বিশালসংখ্যক শিশু স্কুল থেকে ঝরে যাবে। গত দেড় বছরে ছাত্রছাত্রীরা যে ভয়াবহ সংকটে পড়েছে, তার জের কীভাবে তাদের আগামী জীবনে বহন করতে হবে, তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত।

আমাদের দেশের দরিদ্র পরিবারের শিশুরা সবচেয়ে বেশি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মা–বাবার আয়ের পথ বন্ধ হওয়ায় এরই মধ্যে ঢাকাসহ অন্যান্য শহর ছেড়েছে বহু শিশু। অর্থাৎ তাকে পড়তে হলে নতুন জায়গায় নতুন স্কুলে ভর্তি হতে হবে। সেটি তাদের অনেকের পক্ষেই আর সম্ভব হবে না। অর্থনৈতিক দুর্দশার শিকার হয়ে বহু কন্যাশিশুকে বই-খাতা ছেড়ে বসতে হয়েছে বিয়ের পিঁড়িতে। কেউ কেউ যাচ্ছে কলকারখানায়। কেউ গাড়ির হেলপারি করছে। নির্দিষ্ট কোনো গাইডলাইন না থাকায় তারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। নতুন নতুন কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে।

বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বলছে, তারা ৩৩ হাজার শিশুশ্রমিকের ওপর জরিপ করে দেখেছে, কাজ ছেড়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, এমন আড়াই হাজার শিশু করোনাকালে পরিবারকে সহায়তা করতে আবার কাজে ফিরে গেছে। আগের চেয়ে কম পারিশ্রমিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হয়েছে ২ হাজার ৪০০ শিশু। নতুন করে ৭ হাজার ৮০০ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হয়েছে। তাদের আর ফিরে আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই।

‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের কিশোর অপু কলকাতায় অভুক্ত থেকে কলেজের ক্লাস করেছে, লজ্জায় কাউকে সে কথা বলতে পারেনি। এই করোনাকালে তেমন ‘অপু’র সংখ্যা কম নয়। তাই ছোটদের দাবি বড় হয়ে উঠেছে। শিশুদের এই শিক্ষা সুরক্ষায় আপৎকালীন ব্যবস্থা ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি—দুটিই নিতে হবে। অতিমারি সহজে মিলিয়ে যাবে না। তা বারবার আসতে পারে—এটি ধরেই পরিকল্পনা করতে হবে। শিক্ষায় ডিজিটাল বিভাজন দূর করতে সরকারকে দ্রুত বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ প্রয়োজনে দ্বিগুণ বা তিন গুণ করা যেতে পারে।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, টাকা কোথায়? উত্তরে স্মরণ করতে হবে সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘যদি শিক্ষার মূল্য নিয়ে চিন্তিত হও, তাহলে অশিক্ষার কী মূল্য দিতে হবে, তা চিন্তা করো।’ তবে খেয়াল রাখা দরকার, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ও খরচ দেখানোর নাম ‘শিক্ষা’ নয়।

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]