তারুণ্যের জাগরণ ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ

সুড়ঙ্গের অপর প্রান্তে আলোর ছটা
সুড়ঙ্গের অপর প্রান্তে আলোর ছটা

১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠাকালে আমরা আটজন ট্রাস্টি একটি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাই। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হবে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের বস্তুনিষ্ঠ সমগ্র ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত করা, যাতে তারা এ ইতিহাসের আলোকে বর্তমানকে বিশ্লেষণ করে এবং ভবিষ্যতের পথনির্দেশ পায়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বিষয়টিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব হয়নি; আর পঁচাত্তরের পর প্রায় দুই সামরিক শাসনামলে পরিকল্পিত ও ধূর্ততার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তক ও তথ্যমাধ্যমে কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করলাম, সেটি বোঝার উপায় ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ বহুমাত্রিক বিপুল কর্মযজ্ঞ—এ ইতিহাস যেমন বীরত্ব ও গৌরবের, তেমন নৃশংসতা ও বেদনার। পাঠ্যপুস্তকে বীরত্বের বিষয়টি স্থান পায়, কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, বিশেষত তাদের সহযোগী এদেশীয় কুলাঙ্গারদের নৃশংসতা অনুল্লেখিত রয়ে যায়। ফলে, আমাদের প্রজন্মের আশঙ্কা ছিল সম্ভবত আমরা অন্তত একটি প্রজন্মকে হারালাম। গণজাগরণ মঞ্চের তরুণেরা আমাদের এ ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেই স্বল্পতম সময়ে সর্বাধিক মানুষ গণহত্যায় নিহত হয়; জাতিসংঘের উদ্বাস্তু প্রতিষ্ঠানের ভাষ্য অনুযায়ী, এটি ছিল বিশ্বযুদ্ধের পর সর্বোচ্চসংখ্যক শরণার্থীর দেশত্যাগের ঘটনা। ৩০ লাখ শহীদ কেবল সংখ্যার পরিমাপ নয়, প্রতিটি জেলা ও উপজেলা সদর, এমনকি গ্রামে বধ্যভূমি রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সব সভ্য দেশে এ ধরনের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট দল, গোষ্ঠী তথ্যমাধমে নিষিদ্ধ হয়েছে। আর এ দুর্ভাগা দেশে আমরা কয়েক দশক ধরে তাদের বিচারের সম্মুখীন করতে সক্ষম হইনি। স্বস্তির বিষয়, ২০০৯ সালে নির্বাচিত সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু করেছে এবং আন্তর্জাতিক মানের আইনে স্বচ্ছতার সঙ্গে শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রয়েছে। কয়েক বছর ধরে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম ও প্রজন্ম ’৭১ এ দাবি সমুন্নত রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্কুলভিত্তিক কর্মসূচিও বিশেষ ভূমিকা রেখে গণজাগরণ মঞ্চের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। তবে গত বছর প্রতিষ্ঠিত গণজাগরণ মঞ্চ এ দাবি পূরণের কার্যক্রমে প্রচণ্ড গতিবেগ সঞ্চার করেছে। মূলত গণজাগরণ মঞ্চের দাবির ফলেই জাতীয় সংসদে উভয় পক্ষের সমতাভিত্তিক আপিলের বিধান সংযোজিত হয়েছে এবং তার ফলে আপিল বিভাগের পক্ষে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির রায় প্রদান সম্ভব হয়েছে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে গণজাগরণ মঞ্চের এই বিশাল অর্জন জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির যোগ ঘটিয়েছে।
বাংলাদেশে যে মীমাংসিত বিষয়টি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে পরিবর্তন করার কয়েক দশকের অপপ্রয়াস চলেছে, সেটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ, যা ১৯৭২ সালের সংবিধানে চার নীতির মধ্যে নিহিত রয়েছে। বায়ান্ন থেকে একাত্তর অবধি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে এই অঞ্চলের মানুষ যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলন করেছে, তার মধ্য দিয়ে এ নীতিগুলো উৎসারিত হয়েছে। আর এ নীতিগুলো একবিংশ শতাব্দীতে সব আধুনিক রাষ্ট্রের মৌলনীতি ও সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত মূল্যবোধ। আমরা এমন একটি দেশ চেয়েছি, যে দেশে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু বিবেচনায় দেশে জনগোষ্ঠী থাকবে না, সব ধর্ম, আদিবাসীনির্বিশেষে সবাই সম-অধিকারের ভিত্তিতে বসবাস করবে।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর এ নীতিগুলো ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে; কেবল ইতিহাস বিকৃতি নয়, দেশকে পাকিস্তানের আদলে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পিত অপচেষ্টা চলেছে। ২০০৯ সালের সরকার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখে কিছুটা গোঁজামিল দিয়ে হলেও এ নীতিগুলো সংবিধানে প্রতিস্থাপিত করেছে। তবে, এ নীতিগুলো আজও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। স্বাধীনতার পর আমরা আত্মতুষ্টিতে আক্রান্ত হয়েছি এবং ক্ষমতায় আরোহণ করার পর অনেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অর্থ উপার্জনে অতিরিক্ত মনোযোগী হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে পঁচাত্তরের পর পুনর্বাসিত পরাজিত শক্তি পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হয়েছে; তারা আর্থিক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে, আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, ধর্মের উগ্রবাদী ব্যাখ্যা নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছেছে এবং বহুজনের মনোজগতে প্রভাব রাখতে সমর্থ হয়েছে। আজ এই অপশক্তির পরিকল্পিত প্রয়াসের ফলে সমাজের একাংশে জীবনাচারের ক্ষেত্রে তার ধর্মবিশ্বাস কিংবা জাতি-পরিচয়ের মধ্যে কোনটি প্রাধান্য পাবে, সে বিষয়ে দ্বিধা লক্ষ করা যায়। এর ফলে সমাজের অভ্যন্তরে গভীর ও বিস্তীর্ণ বিভাজনও লক্ষ করা যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক হামলার পর জনপ্রতিনিধিরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যান না, নির্বাচনী কৌশলের কাছে নীতি পরাস্ত হয়, একটি মানবিক সমাজ গড়ার জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিও ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণে সমর্থ হয় না।
সমাজের এই সংকটকালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত গণজাগরণ মঞ্চ মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শকে হূদয়ে ধারণ করেছে। নির্বাচনোত্তর সাম্প্রদায়িক হামলার পর তাদের রোডমার্চ তার সাক্ষ্য বহন করে। প্রায় পাশাপাশি সময় বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও-এর পক্ষ থেকে দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও পরিদর্শনের সময় আমার মনে হয়েছে, তাদের এ কর্মসূচি স্থানীয় তরুণসমাজকে উদ্দীপ্ত করেছে এবং হিন্দুধর্মাবলম্বীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হয়েছে।

দুই
আমার বিবেচনায় গণজাগরণ মঞ্চ কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি ফেনোমেনোন। ইতিহাস বিকৃতি সত্ত্বেও সেক্যুলার শিক্ষায় শিক্ষিত যে তরুণসমাজ মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শকে হূদয়ে লালন করেছে, কয়েক বছর ধরে অনলাইন নেটওয়ার্কে লক্ষাধিক তরুণদের কাছে এ বাণী পৌঁছে দিয়েছে, এটি তার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। এটি যথেষ্ট ফোকাসড কার্যক্রম; মূল দাবি যুদ্ধাপরাধীদের প্রচলিত আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, তাদের বিপুল অর্থের উৎস রোধ করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমাজ ও রাষ্ট্রে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এই নতুন প্রজন্ম গত চার দশকের প্রতিবাদী সমাবেশের সংস্কৃতি বদলে দিয়েছে। শাহবাগসহ সারা দেশে মানুষ যোগ দিয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তাদের অর্থের বিনিময়ে কিংবা ভাড়া করা যানবাহনে আনতে হয়নি, মহাসমাবেশে অগুনতি মানুষ এসেছে কাঁধে শিশুসন্তান নিয়ে, দিবারাত্রি সবাই খাবার ভাগ করে নিয়েছে, মানিব্যাগ কিংবা মুঠোফোন নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই।
এ জনসমুদ্রের অংশগ্রহণকারী কারা? তারা যুদ্ধাপরাধের বিচার চায়, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে, কিন্তু প্রচলিত সাংঘর্ষিক রাজনীতির নিরন্তর কূটকচালে বীতশ্রদ্ধ। তারা মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শে সাধারণভাবে বিশ্বাসী ও সমর্থক, কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহারের তীব্র সমালোচক। তারা কর্মজীবী ও শ্রমজীবী মানুষ, যারা জনসভা কিংবা মিছিলে যোগ দেয় না, তাদের চাহিদা একটি নির্দলীয় প্ল্যাটফর্ম, যা গণজাগরণ মঞ্চের প্রাথমিক পর্ব পূরণ করেছে।
অবশ্য গণজাগরণ মঞ্চকে এক বছর ধরে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে হয়েছে। সারা বছর ধরে যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম বানচাল করতে আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের অর্থ ও সমর্থনপুষ্ট হয়ে জামায়াত-শিবির চরম নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে এবং তাদের প্রশ্রয় দিয়েছে প্রধান বিরোধী দল। বিশ্বব্যাপী গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছে তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থাসহ কিছু তথ্যমাধ্যম। নিহত হয়েছে গণজাগরণ মঞ্চের বেশ কয়েকজন মেধাবী কর্মী। বহুবার বাইরের বৃত্তে দাঁড়িয়ে তাদের বক্তব্য শুনেছি, কখনোই ধর্ম সম্পর্কে কোনো কটূক্তি শুনিনি; অথচ তাদের নাস্তিক আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং কিছু মানুষ এ অপপ্রচারে বিভ্রান্তও হয়েছে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ধর্ম ও রাজনীতি উভয়কেই কলুষিত করেছে; এর ফলে অতি সতর্ক এবং শতভাগ আনুগত্যপ্রত্যাশী রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বেড়েছে।
তরুণদের এ জাগরণ নতুন নয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে এই অঞ্চলের প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা। ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় থাকার সুযোগ হয়েছে, তরুণসমাজের সেই আন্দোলন ছিল মূল ধারার সংগ্রামে বর্শাফলকের মতো। আমাদের মুক্তিবাহিনীতেও তরুণেরাই প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনেও তারা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। যৌবনে বৈষয়িক চিন্তা প্রাধান্য পায় না, তরুণদের নৈতিক ভিত্তি ও আবেগ অনেক সবল ও প্রবল থাকে। আর আজ ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার ফলে কিছু তরুণের অধোগতি সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে তরুণসমাজ নৈতিক অবস্থানে দৃঢ় রয়েছে।
তবে গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের আরব বসন্তের তুলনা যথার্থ নয়। মিসরসহ অন্যান্য দেশে প্রায় ছয় দশক ধরে প্রকারান্তরে সামরিক শাসন চলেছে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। সেই দেশে একমাত্র সংগঠিত শক্তি ইসলামিক ব্রাদারহুড। অন্যদিকে, বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঐতিহ্য রয়েছে, শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি লক্ষণীয় এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে। আর মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রশাসনের নতুন ‘রেজিম চেঞ্জের’ তত্ত্ব আল-কায়েদার অনুপ্রবেশ নিশ্চিত করেছে। অবশ্য গণজাগরণ মঞ্চের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ব্যক্তিরা নানা ধারার নেতা-কর্মী, বাংলাদেশের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক মহলের দ্বৈত নীতি বিবেচনায় নিয়ে তাদের অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন।
কয়েক দশক ধরে রাজনীতি ও সমাজের নানা ধারা ও প্রবণতায় প্রায়ই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। গণজাগরণ মঞ্চে সুড়ঙ্গের অপর প্রান্তে আলোর ছটা দেখছি, যে আলো উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে।
সারওয়ার আলী: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি।