তারে বলা যায় ঘনঘোর বরিষায়...

noname
noname

ঘোর বর্ষায় মাঝেমধ্যে মনে হয় বড় মন্দভাগ্য জাতি ইংরেজ। এত বিত্ত-বৈভব থাকা সত্ত্বেও জীবনটা কাটিয়ে দিল সে মাত্র চারখানা ঋতু নিয়ে—শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম আর শরৎ। সারা বছর ধরেই টিপটিপ বৃষ্টি সে দেশে। তাই বর্ষার জন্য একটা বাড়তি ঋতু খরচ করতে মন ওঠেনি হিসেবি ইংরেজের। সে দেশের ঋতু পর্যায় থেকে বাদ পড়েছে বর্ষা, নিত্যদিনের সঙ্গী বলে বেচারার মান নেই সেখানে।
আমাদের ছয় ঋতুর দেশে বর্ষার মর্যাদাই আলাদা। পঞ্জিকার বেঁধে দেওয়া আষাঢ়-শ্রাবণ দুটি মাসের রাজত্বে তার মন ভরে না। কোনো কোনো বছর আষাঢ়ের আগেই এসে পড়ে বর্ষা; মাঝেমধ্যে আশ্বিনের আঙিনা ছাড়িয়ে কার্তিকেও আকাশ ছাড়ার নাম নেই। তার চালচলনে পুরোনো দিনের রাজরাজড়ার মেজাজ। বজ্র, বিদ্যুৎ আর ঝড়ের তূর্যনাদের মধ্যেও আবির্ভাব তার রাজার মতোই। বর্ষার মর্জিমেজাজ বুঝেই এ দেশের মানুষের চাষবাস, চলাফেরা, বিয়েশাদি আর পালাপার্বণ উদ্যাপন। যথার্থ যদি ঋতুর রাজা কাউকে বলতে হয়, তাহলে এই অভিধাটি বর্ষারই প্রাপ্য।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দিল্লির শক্তিধর সুলতান-বাদশাহরাও বাংলার বর্ষাকে সমঝে চলেছেন। বর্ষা মৌসুমে বাংলা অভিযানের চিন্তা মাথায়ও আনতেন না পররাজ্যলোভী সেই প্রতাপশালীরা। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক বাংলা আক্রমণ করেছিলেন দুবার। প্রতিবারই বর্ষা নামার আগেই বুদ্ধিমানের মতো অবরোধ উঠিয়ে বা বাংলার স্বাধীন সুলতানের নামেমাত্র বশ্যতা আদায় করেই বাংলা ছেড়ে দিল্লির পথে পাড়ি দিয়েছেন। ফিরোজ শাহ আর কখনো বাংলামুখী হননি। মোগল বাদশাহরাও বাংলার বর্ষাকে হেলাফেলা করার দরুন মাশুল গুনেছেন। বারভূঁইয়াদের দমন করার পরিকল্পনা অসমাপ্ত রেখেই আকবরের ঘোড়সওয়ার বাহিনীকে বর্ষায় নাকাল হয়ে দিল্লিতে ফিরে যেতে হয়েছিল। পরে ঢাকায় রাজধানী সরিয়ে এনে বিশাল নৌবাহিনী মজুত করে জাহাঙ্গীরের দীর্ঘদিন লেগেছিল বাংলা মুলুকে মোগল আধিপত্য কায়েম করতে। নবাবি আমলে নয় বছরব্যাপী বর্গি হামলার সেই দুঃসময়ে বাংলার সাধারণ মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছিল বাংলার অঝোর বর্ষা। ধূর্ত বর্গিরা ভালো করেই জানত যে বর্ষার ঝড়জলে বাংলার কাদামাটিতে তাদের একমাত্র বাহন ঘোড়া অচল। সেই সময়টা লুটেরারা দুর্গের মধ্যে বসে বসে কাটাত। তাই বর্ষা নামার সঙ্গে সঙ্গে ‘বরগি লুটীবারে নাই’ পায়, হত্যা আর নারী নির্যাতনও জমে যেত। সমসময়ে লেখা গঙ্গারামের মহারাষ্ট্র পুরাণ-এ এমনই ইঙ্গিত রয়েছে।
“আষাড় মাসের দেওয়া ঘন বরিসন।
অজত্র ভাসিয়া গঙ্গা ভরিল তখন/
গঙ্গা ভরিল জদি ইপার উপার
তবে বরগি লুটীবারে নাই পাত্র আর”
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবল বর্ষা আর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথ আক্রমণে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর দুর্দশার ইতিহাস সবারই জানা।

দুই.
ছাত্রজীবনে পড়া বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বৃষ্টি’ প্রবন্ধের কথা হয়তো অনেক পাঠকের মনে রয়েছে এখনো। ‘বৃষ্টি’রা দলবেঁধে মেঘকে আহ্বান করে বলেছে ‘বৃষ্টিকুল প্রসূতি! এসো নভোমণ্ডল আচ্ছন্ন কর, আমরা নামি। আমরা ডেকে ডেকে, হেসে হেসে নেচে নেচে ভূতলে নামি।’ বঙ্কিমের কলমে এই স্বভাব-রসিক বৃষ্টির রসিকতার রঙ্গভরা বর্ণনার কমতি নেই। এরা ভরদুপুরে অথবা রাতের অন্ধকারে পাড়াগাঁয়ের দম্পতির চাল ফুটো করে উঁকি মারে। কখনো বা যে পথে সুন্দরী বউ জলের কলস নিয়ে যায়, সে পথকে পিছল করে তোলে।
গৃহস্থ কাপড় শুকাতে দিলে তা ভিজিয়ে দেয়। গাছের, ধানের ডগা, ছেলের দল ভিজতে থাকে বৃষ্টিতে। নদীর দুকূল ছাপিয়ে চলা জলরাশিকে নাচিয়ে নাচিয়ে যে বর্ষার আগমন, এ বছরও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। আবহাওয়া চক্রে প্রবল বিধ্বংসী পরিবর্তন না হলে বর্ষা আসবে আরও বহুদিন ধরে। সেই অনাগত ভবিষ্যতে, মানুষের জীবন যখন প্রযুক্তি আর যন্ত্রের করুণানির্ভর হয়ে প্রাণের উচ্ছলতা হারিয়ে ফেলবে, সেদিনও বর্ষা এলে লেখা হবে কবিতা, বাঁধা হবে গান। আকাশে কালো মেঘের হাত ধরে বৃষ্টি এলে মন-খারাপ-করা বিকেল হঠাৎ জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে সব হিসাব বেহিসাব করে দেবে। সেই মুহূর্তে চরম বস্তুবাদীরও মনে হবে—এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘনঘোর বরিষায়...।
বর্ষার পদ্মা নিয়ে কবি-অকবি সবারই উচ্ছ্বাস প্রবল। তুলনায় বর্ষার মেঘনা যেন কাব্যে উপেক্ষিতা। অথচ আষাঢ়-শ্রাবণের নোয়াখালী। মেঘনায় বান যারা দেখেছেন, তাঁরা জানেন বাংলাদেশের অন্য নদীর মতো এই দৃশ্য জোয়ারের ঢেউ খেলা নয়—এই ‘বান’ প্রকৃতির এক প্রচণ্ড মহিমাময়ী প্রকাশ, যা বাংলাদেশের আর কোথায়ও দেখা যায় না। নোয়াখালীর বাগরীতিতে নদীতে বান ডাকে না, ‘শর’ আসে। অমাবস্যা-পূর্ণিমায় শর আসে মোহনার মধ্যে মিলিয়ে যাওয়া মেঘনা নদীতে। সাদা ফেনার মুকুট মাথায় দিয়ে গর্জন করে দূর থেকে সেই ‘শর’ আসার দৃশ্য দেখেছিলাম নোয়াখালীর সোনাপুর রেলস্টেশনের দক্ষিণে চরের ওপারে। বহুদিন আগে একদা নোয়াখালী জিলা স্কুলের নিচের ক্লাসের ছাত্রের চোখ থেকে সেই দৃশ্য আজও মুছে যায়নি। বৈশাখ থেকে কার্তিক অবধি এই জলোচ্ছ্বাস, এই ‘শর’, এই জোয়ার চলতেই থাকে।
বর্ষা যে বন্দনীয় ঋতু—বাঙালি ছাড়া তা আর কে বেশি জানে? তবে এর সবটাই প্রণয়সঞ্জাত নয়। ভীতিও এই বন্দনার কারণ। রাজধানীর জলমগ্ন রাজপথ নিরীহ নগরবাসীর কর্মপথকে জটিল ও অনিশ্চিত করে তোলে—তা সবারই জানা। প্রশাসনকে সমালোচনা করে জলপথ পেরোনো যে প্রায় দুঃসাধ্য, তা দপ্তরগামী পুরবাসীরও অজানা নেই। এই ‘পানিপথে’ জয়ী হতে হলে অন্য সব যানবাহন যখন অচল, তখন রিকশাই ভরসা। এই বার্ষিক বিভ্রাট এড়াতে সম্মিলিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রচেষ্টার অভাব রয়েছে, তা-ও নগরবাসীর অজ্ঞাত নয়। পানিনিষ্কাশনের যেটুকু ক্ষমতা কর্তৃপক্ষের হাতে রয়েছে, তা অল্প সময়ের মধ্যে প্রবল বৃষ্টিপাতের তুলনায় অবশ্যই যথেষ্ট নয়। সময়মতো হেজেমজে যাওয়া খালগুলো উদ্ধার হলে, শহরের নালা-নর্দমা পরিষ্কার থাকলে আর নগরের আশপাশের নদী ও জলাশয় দখলমুক্ত হলে সমস্যার সমাধান হতে পারে। আজকাল বর্ষার স্বভাবটাও যেন পাল্টে গেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে উপমহাদেশের সব জায়গাতেই অল্প সময়ের মধ্যে অতিবৃষ্টির প্রবণতা বেড়েই চলেছে। দু-তিন দিন ধরে বৃষ্টি হলে যে পরিমাণ পানি জমার কথা, আজকাল তা এক-দুই ঘণ্টার বৃষ্টিতেই হয়ে যায়। বৃষ্টি যেন বড় অস্থির, যুগের বাতাস লেগেছে এর গায়ে। যেন তার সময় বড় কম। ‘বর্ষা এলায়েছে তার মেঘময় বেণি’ কথাটা মনে হয় যেন কোনো অতীতের দীর্ঘশ্বাস।
বর্ষার কোমল রূপের পাশাপাশি তার বিধ্বংসী রূপটিও বাস্তব সত্য। অনাবৃষ্টি যেমন ক্ষতিকর, অতিবৃষ্টি বা প্রলম্বিত বর্ষাও ভয়ের কারণ। বর্ষার নতুন পানির বড় খিদে। খেতের ধান গিলতে কত আর সময় লাগে কমবয়সী পানির লকলকে জিবের! আষাঢ়ে বৃষ্টির তোড় বাড়লে জলে ডোবা মানুষের মতো হাত উঁচিয়ে ধানগাছ প্রাণপণে ঠেকাতে চায় পানির স্রোত। অতিবৃষ্টির কারণে ফসলহানি, বন্যা, ভূমিধস, নদীভাঙায় মানুষ-প্রাণী-গাছপালা সবার জন্যই ভয়াবহ। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষিশ্রমিক বা কৃষি দিনমজুর, বর্গাচাষি, শহরের দিনমজুর অথবা ছোট ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী।
এত কিছুর পরও জন্ম-রোমান্টিক বাঙালির বর্ষা-প্রণয় কমেনি। বাঙালির বর্ষাবন্দনারও ঘাটতি নেই। তার হাতে ধরা কাঁঠালি চাঁপার গায়ে কয়েক ফোঁটা আষাঢ়ি বৃষ্টি যেন শুকোতেই চায় না।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, বর্ষার নানাখানা মন একখানা হয়ে যায়। এই একখানা মন নিয়ে বাঙালি বর্ষায় জীবনের সব আনন্দ-বেদনা-বিরহ স্পষ্ট খুঁজে বেড়ায়। ঘনকালো মেঘ, আকাশের বদলে যাওয়া রং বৃষ্টির একটানা ঝমঝম শব্দের জোয়ারে ভেসে বর্ষায় বাঙালি নিজের মতো আপন আপন মেঘদূত রচনা করে চলে।
মাহবুব আলম: সাবেক রাষ্ট্রদূত, প্রবন্ধকার।
[email protected]