প্রবীণদের পেছনে ফেলে এগোনো যাবে না

এবারের প্রবীণ দিবসের ডাক: বৈশ্বিক মহামারির বার্তা: প্রবীণদের সেবায় নতুন মাত্রা
ছবি: প্রথম আলো

এ বছরের ১ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের ৩০তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। করোনা মহামারিকে মাথায় রেখে জাতিসংঘ এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ঠিক করেছে, ‘Pandemics: Do They Change How We Address Age and Ageing?’ এর বাংলা করা হয়েছে, ‘বৈশ্বিক মহামারির বার্তা: প্রবীণদের সেবায় নতুন মাত্রা’। বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনার প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্য বিষয়টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও অর্থবহ।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে বিশেষভাবে গ্রামবাংলায় প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই দরিদ্র, ফলে জীবন বাঁচানোর জন্য কর্মহীন শেষ বয়সে তাঁরা সন্তানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। সন্তানদের একটি বড় অংশও দরিদ্র বা নিম্নবিত্তে অবস্থান করায় প্রায়ই তাদের ওপর নির্ভরশীল পিতামাতার ন্যূনতম থাকা-খাওয়ার প্রয়োজন মেটাতে তারা অপারগ থাকে। বার্ধক্যে খাওয়া-পরার বাইরে আরও কিছু অনুষঙ্গ থাকে। এর প্রধান একটি হচ্ছে বার্ধক্যকালীন রোগব্যাধি।

প্রকৃতিগতভাবেই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ শারীরিক-মানসিক অবক্ষয়ের মুখে পড়ে; যে কারণে শরীরে নানাবিধ রোগব্যাধি বাসা বাঁধে। এমনকি কখনো কখনো শারীরিক-মানসিক বৈকল্যও তাদের সঙ্গী হয়ে ওঠে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব বার্ধক্যকালীন রোগের আধিক্য ও তীব্রতার মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে দৈনন্দিন খাওয়া-পরার বাইরে প্রবীণ বয়সে মানুষের আরেকটি অপ্রতিরোধ্য চাহিদা হয়ে ওঠে চিকিৎসাসেবা। সত্যি বলতে কি, বার্ধক্যে বেঁচে থাকা ও সুস্থ জীবনযাপনের এটি এক প্রধান অনুষঙ্গ। প্রবীণদের এসব রোগের অধিকাংশই অসংক্রামক হওয়ার কারণে তাঁদের চিকিৎসা হয় দীর্ঘমেয়াদি, ব্যয়বহুল ও কিছুটা ঝামেলাপূর্ণ—বারবার চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে হয়, মাঝেমধ্যে হাসপাতলেও ভর্তি হতে হয়। তা ছাড়া ওষুধের উচ্চ মূল্য ইত্যাদি তো রয়েছেই।

এ সবকিছু নিয়ে দেশের অধিকাংশ প্রবীণ যখন জীবন বাঁচানোর ন্যূনতম খাওয়া-পরা ও চিকিৎসার প্রয়োজন মেটাতে নানাবিধ দুরবস্থার ভেতর দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, তখন করোনার আবির্ভাব তাঁদের চলমান সংকটকে আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। যে সন্তানের ওপর নির্ভর করে তাঁদের জীবনযাপন, সেই সন্তানদের জীবন-জীবিকাই করোনার প্রাদুর্ভাবে নিদারুণ সংকটের মুখোমুখি। এর ফলে অনেক সন্তানই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও করোনাকালীন দুঃসময়ে মা–বাবার দায়িত্ব বহন করতে অপারগ থেকেছেন; এমনকি মা–বাবার দায়িত্ব বহনের বাড়তি চাপের কারণে অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবা ও সন্তানের সম্পর্কে টানাপোড়েনও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর বহিঃপ্রকাশ আমরা মা–বাবার প্রতি সন্তানদের নির্মমতা, ‍নিষ্ঠুরতা বৃদ্ধির মধ্যে দেখতে পেয়েছি।

চিকিৎসার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অদক্ষতা, অবহেলার কথাও আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। এরও প্রধান শিকার প্রবীণেরা। করোনাকালে প্রবীণদের এই সীমাহীন ‍দুর্ভোগ ও বঞ্চনাকে মাথায় রেখেই জাতিসংঘের এবারের প্রতিপাদ্যের ইঙ্গিত। সংগতভাবেই আমরা আশা করতে পারি, সরকার এই দুঃসময়ে প্রবীণ জনগণের সমস্যাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে ভাববে এবং এর সমাধানে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসবে। প্রবীণেরাও এ দেশের নাগরিক, সংবিধান অনুযায়ী নাগরিক অধিকারের দাবিদার তাঁরাও। তাঁদের মৌলিক চাহিদা পূরণ রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। তাই প্রবীণকল্যাণ নিশ্চিতে প্রবীণের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে কয়েকটি অনুরোধ বা আবেদন রাখতে চাই, যাতে বর্তমানের দেড় কোটিসহ ভবিষ্যতের অসংখ্য প্রবীণ শান্তিতে, মর্যাদার সঙ্গে অধিকার নিয়ে জীবনের শেষ কটি বছর কাটাতে পারেন।

তাই:

১. ষাটোর্ধ্ব সব প্রবীণের জন্য বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করা হোক এবং বয়স্ক ভাতার পরিমাণ সম্মানজনক ও প্রবীণদের চাহিদা পূরণের জন্য ন্যায্য পরিমাণে নির্ধারণ করা হোক।

২. প্রবীণদের জন্য বিনা মূল্যে বা হ্রাসকৃত মূল্যে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা হোক; গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে শহরের মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত সর্বত্র তাঁদের চিকিৎসার জন্য আলাদা লাইন, ওয়ার্ড, নির্দিষ্টসংখ্যক বেডসহ সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা করা হোক।

৩. প্রবীণদের রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হোক। শিশুদের জন্য চলমান ইপিআই প্রোগ্রামের অধীনে প্রবীণদের জন্য নিউমোনিয়া ও ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

৪. প্রবীণদের সুচিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তোলা হোক এবং মেডিকেল কারিকুলামে যথাযথ গুরুত্বসহকারে জেরিয়াট্রিক কোর্স প্রবর্তন করা হোক। এতে করে প্রবীণদের স্বাস্থ্য সমস্যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি বিশেষায়িত বিভাগ হিসেবে চালু করা যাবে।

৫. শারীরিক ও মানসিকভাবে অক্ষম, অসমর্থ প্রবীণদের জন্য সেবার ব্যবস্থা করা হোক এবং এ জন্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কমিউনিটিভিত্তিক সেবাদানকারী তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হোক।

৬. পরিত্যক্ত, সন্তানহীন অসহায় প্রবীণদের জন্য যথোপযুক্ত সুবিধাদিসহ প্রবীণ নিবাসের ব্যবস্থা করা হোক।

৭. গরিব অসহায় প্রবীণদের কম মূল্যে খাদ্য সরবরাহ এবং গৃহহীন প্রবীণের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হোক।

৮. প্রবীণ ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারকে বিভিন্ন সেবা, যেমন বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, স্থানীয় কর ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড়ের সুবিধা দেওয়া হোক। এতে তাঁদের জীবন সহজ হবে এবং যৌথ পরিবারের ধারণাও উৎসাহিত হবে।

৯. প্রবীণদের যাতায়াতের জন্য সব রকম যানবাহনে নির্দিষ্টসংখ্যক সিট বরাদ্দসহ সস্তা ভাড়ায় যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হোক।

১০. শারীরিক ও মানসিকভাবে সক্ষম প্রবীণদের আয়-উপার্জনকারী কাজের ব্যবস্থা নেওয়া হোক, যাতে তাঁরা সম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারেন এবং গড় আয়ু বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হোক।

১১. সক্ষম প্রবীণদের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক, যাতে তাঁরা নতুন সৃষ্টি হওয়া কর্মক্ষেত্রে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারেন।

১২. প্রবীণদের ভালো-মন্দ দেখভালের জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে শিক্ষা বা স্বাস্থ্য কমিটির মতো প্রবীণ কমিটি করা হোক।

১৩. প্রবীণদের সমস্যা ও সম্ভাবনার বিষয়ে সমাজে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হোক; পাঠ্যপুস্তকে প্রবীণবিষয়ক বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করে নতুন প্রজন্মকে বার্ধক্য বিষয়ে সচেতন এবং সেই সঙ্গে নবীন-প্রবীণের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরিতে উদ্যোগ নেওয়া হোক।

১৪. প্রবীণকল্যাণ নিশ্চিত করতে প্রবীণদের জন্য একটি আলাদা মন্ত্রণালয়/অধিদপ্তর গঠন করা হোক।

শরীফা বেগম: সাবেক সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বিআইডিএস।