ভোটের দিন সাতক্ষীরায়

যশোর সদর থেকে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার দূরত্ব ৯০ কিলোমিটারের মতো। কিন্তু যখন তালায় পৌঁছলাম, তখন মোটরসাইকেলের মিটার যাত্রার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছে দেখাল। প্রধান সড়ক দিয়ে যাওয়া যায়নি। অবরোধকারীদের হাতে তিন দফা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অগত্যা ঘুর পথে গ্রামের ভেতর দিয়ে তালায় পৌঁছতে হয়েছে। তাই বাড়তি এই পথ পেরোনো। তালায় রওনা হওয়ার আগে বন্ধু ও সহকর্মীদের বারবার সাবধানবাণী শুনতে শুনতে আমার ভেতরেও যে ভয় ধরেনি, তা নয়। কিছুটা আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা নিয়েই তালার মাটিতে পা রাখলাম।
কিন্তু তালায় পৌঁছার পর ভয় কিছুটা হলেও ভাঙল। মহাসড়ক ও গ্রামীণ সড়কগুলোতে সুনসান নীরবতা। কোথাও অবরোধকারীদের দেখা মিলল না। পথে পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল চোখে পড়ল। বিকেলে তালা উপজেলা সদরে পৌঁছার পর দেখা গেল, বাজারের বেশির ভাগ দোকান বন্ধ। মোটরসাইকেলের চালক বারবার সাবধান করে দিয়ে মনের ভেতর পেট্রলবোমা ছোড়ার ভয় জাগিয়ে দিচ্ছিলেন। কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই নির্বাচনের আগের দিনটি পার হলো।
নির্বাচনের দিন সকালে ভোট দেখতে বের হলাম। তিন-চারটি কেন্দ্রে ভোট দেখার পর দুপুর ১২টার দিকে তালার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মহাবিদ্যালয় কেন্দ্রে গেলাম। সেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে এসেছেন তাঁরা। ওই কেন্দ্রে প্রবেশ করার ঠিক আগ মুহূর্তে মুঠোফোনে খবর এল, জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ইসলামকাঠি ইউনিয়নের বেশির ভাগ কেন্দ্রের পাশে জড়ো হচ্ছেন। তাঁরা চারটি কেন্দ্রে যাওয়ার সড়ক বিদ্যুতের খুঁটি ও গাছ ফেলে আটকে অবরোধ সৃষ্টি করেছেন। ডাঙ্গা আলিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্র দখল করে সেখানে ধারালো অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নিয়েছেন জামায়াতের কর্মীরা।
এই খবর শোনার পর বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জানালাম। তাঁরা ইসলামকাঠি ইউনিয়নের বিভিন্ন কেন্দ্রে অবরোধ সৃষ্টির সংবাদটি সঠিক নয় বলে উড়িয়ে দিলেন। আরেকটু আগ বাড়িয়ে বললেন, ছোটখাটো কিছু অবরোধ ছিল, তা পুলিশ-বিজিবি কিছুক্ষণ আগে সরিয়ে ফেলেছে। এখন কোথাও কোনো সমস্যা নেই। সবাই শান্তিমতো ভোট দিচ্ছেন। নির্বাচনী কর্মকর্তারা যখন এসব কথা বলছেন, তখন আবারও মুঠোফোনে ডাঙ্গা কেন্দ্র থেকে খবর এল, ভোট দিতে আসা একজন বৃদ্ধাকে জামায়াতের কর্মীরা তুলে নিয়ে গেছেন। ভোটকেন্দ্রে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন তাঁরা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে আরেকজন স্থানীয় সাংবাদিককে সঙ্গে নিয়ে ইসলামকাঠি ইউনিয়নের পথে রওনা হলাম। বেলা তখন একটা। সড়ক দিয়ে যাওয়ার পথে চারটি কেন্দ্র অতিক্রম করলাম। বেশির ভাগ কেন্দ্র ফাঁকা। রাস্তায়ও কোনো লোকজন চোখে পড়ল না। যে দু-একজন পথচারী চোখে পড়ল, তাদের চোখে-মুখে আতঙ্ক। ডাঙ্গা কেন্দ্রে যাওয়ার পথে দেখলাম, সত্যি সত্যি বাঁশ, গাছ ও বিদ্যুতের খুঁটি ফেলে রাখা হয়েছে। দূর থেকে নির্বাচনী কেন্দ্র দেখা যাচ্ছে। নির্বাচন প্রতিরোধকারীরা সেখানে মিছিল করছে। আমাদের দেখে সেখান থেকে কয়েকজন তেড়ে এল।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে আমরা পিছু হটলাম। সঙ্গে থাকা স্থানীয় সাংবাদিকেরা তালা থানার যৌথ বাহিনীর ক্যাম্পে খবর দিলেন। ১০-১৫ মিনিট অপেক্ষা করার পর বিজিবি ও পুলিশের দুটি গাড়ি এসে উপস্থিত হলো। তারা প্রায় ২০টি ফাঁকা গুলি ছুড়ল। অবরোধকারীদের সঙ্গে তাদের কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটল। শেষ পর্যন্ত অবরোধকারীরা পিছু হটল।
এ ঘটনা যখন চলছিল তখন স্থানীয় অন্য সাংবাদিকেরা কিছুক্ষণ পর পর ফোন দিচ্ছিলেন। ইসলামকাঠি ইউনিয়ন এলাকা ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিলেন তাঁরা। নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তাই বিজিবির গাড়ির পেছন পেছন ইসলামকাঠি ইউনিয়ন এলাকা ত্যাগ করলাম। সন্ধ্যায় নির্বাচনের
ফলাফল ঘোষণার সময় দেখা গেল, তালা থানার পুলিশের দুজন কর্মকর্তা কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে গুলি ছোড়ার অনুমতিপত্রে স্বাক্ষর নিচ্ছেন।
নির্বাচনের দিন বিকেল পর্যন্ত তালা উপজেলার কমপক্ষে ১৫টি কেন্দ্র ঘুরে দেখা হলো। তিনটি কেন্দ্রে সারি ধরে ভোটারদের ভোট দিতে দেখা গেল। বাকিগুলোতে নির্বাচনসংক্রান্ত কর্মকর্তা ও প্রার্থীদের পক্ষের লোকদের তুলনায় ভোটারের সংখ্যা কম দেখা গেল।
পরদিনের প্রথম আলোতে ডাঙ্গা ইউনিয়নের অবরোধ ও সংঘাতের সংবাদসহ নির্বাচন বিষয়ে প্রতিবেদন ছাপা হলো। সকালে সাতক্ষীরা সদরে প্রথম আলো কার্যালয়ে পৌঁছালাম। পৌঁছার পরপরই প্রথম আলোর সাতক্ষীরার নিজস্ব প্রতিবেদক কল্যাণ ব্যানার্জির কাছে ফোন এল। সাতক্ষীরার জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে বলা হলো, ‘এ ধরনের কোনো অবরোধ ইসলামকাঠিতে হয়নি। সবকিছু শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। সবাই ঠিকমতো ভোট দিয়েছেন। আপনার পত্রিকায় সঠিক সংবাদ আসেনি।’
কল্যাণ ব্যানার্জি মুঠোফোনেই ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আমাদের প্রতিবেদক ঘটনাস্থলে ছিলেন। তিনি যা দেখেছেন, তা-ই লিখেছেন।’ অপর প্রান্ত থেকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলা হলো, ‘না, এমন কোনো কিছু ঘটেনি।’
ইফতেখার মাহমুদ: সাংবাদিক।