যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন: সব হিসাবই যখন অনিশ্চিত

যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন
রয়টার্স ফাইল ছবি

যেকোনো নির্বাচনের তিন দিন আগে কোনো ধরনের পূর্বাভাস বা ভবিষ্যদ্বাণী করা বিপজ্জনক, বিশেষ করে তা যদি হয় ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। চার বছর আগের নির্বাচনে বিশ্লেষকদের নিশ্চিত রায় ভুল প্রমাণিত হওয়ার পরে এবারের নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে কেউই সংশয় মুক্ত নন, যেকোনো ধরনের আলোচনায় এমনকি নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের সতর্ক মন্তব্যই করছেন।

জাতীয় এবং লড়াইক্ষেত্র রাজ্যগুলোর জনমত জরিপগুলো অব্যাহতভাবে একই ধরনের ফলাফলের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিলেও বিশ্লেষকেরা কেউই নির্দ্বিধায় বলছেন না যে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেন বিজয়ী হবেন। কিংবা বিপরীতক্রমে রিপাবলিকান প্রার্থী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যাঁরা বিজয়ী দেখতে চান, তাঁরা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না ২০১৬ সালের পুনরাবৃত্তি হবে। বিশ্লেষকদের এই সংশয়ের কারণ একাধিক।

প্রথমেই ২০১৬ সালের জরিপের ভুলভ্রান্তির কথা সবাই বলছেন। কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়। আরেকটি কারণ হচ্ছে করোনাভাইরাস। যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ধাক্কা চলছে, আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা লাগামছাড়া হয়ে গেছে। অন্তত ৪১টি রাজ্যে গত দুই সপ্তাহে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা, হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা, মৃত্যুর সংখ্যা জুলাই মাসের প্রথম ধাক্কাকে ছাড়িয়ে গেছে। এরই মধ্যে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করে চলেছেন যে মহামারি শেষ হয়ে গেছে, অবস্থা ভালো হচ্ছে এবং যদিও ওষুধ প্রস্তুতকারীরা বলছেন যে টিকার পরীক্ষাই এখনো শেষ হয়নি; কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলছেন, খুব শিগগির ভাইরাসের টিকা সবার জন্য পাওয়া যাবে।

বিপরীত দিকে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেন আগাগোড়াই বলে আসছেন, প্রেসিডেন্টের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ এবং বিজ্ঞান ও বিশেষজ্ঞদের অবজ্ঞা করার কারণেই যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর হার বেশি। এ পর্যন্ত দেশে মারা গেছেন ২ লাখ ২৮ হাজার মানুষ; ৩ নভেম্বর ভোট দেওয়ার সময়সীমা যখন শেষ হয়ে যাবে, সেই সময়ে এর সঙ্গে যুক্ত হবে আরও কয়েক হাজার মানুষ। এই করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতিতে ধস নেমেছে, বেকারত্ব বেড়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রভাব ভোটারদের সিদ্ধান্তে কতটা এবং কীভাবে ফেলবে, তা জানার উপায় নেই। কেননা, এই ধরনের অবস্থা আগে হয়নি। শুধু এইটুকু বলা যেতে পারে যে অতীতে জাতীয় বিপর্যয়ের সময়ে যে প্রার্থী এই সমস্যাকে মোকাবিলা করার সুনির্দিষ্ট পথে দেখাননি, তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় প্রাধান্য দেননি, তিনি পরাজিত হয়েছেন। কিন্তু করোনাভাইরাস আর যেকোনো বিপর্যয় থেকে ভিন্ন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
ছবি: রয়টার্স

যেকোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে একজন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের পুনর্নির্বাচনের যেকোনো সম্ভাবনা তিরোহিত হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট ছিল যে তিনি করোনাভাইরাস নিয়ে বারবার বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন, যা প্রায় আড়াই লাখ নাগরিকের মৃত্যুতে অবদান রেখেছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোনো প্রথাসিদ্ধ প্রার্থী নন, গত প্রায় পাঁচ বছরে তিনি তাঁর কট্টর সমর্থকদের যে গোষ্ঠী গড়ে তুলেছেন, তার আকার ছোট নয়। প্রেসিডেন্টের কাজে সন্তুষ্ট এমন ব্যক্তিদের গত চার বছরের যদি গড় করা হয় তবে তার হার প্রায় ৪০ শতাংশ, গতকাল বৃহস্পতিবার তা ছিল ৪৪ শতাংশ; এদের মধ্যে অন্তত ৩৫ শতাংশকে প্রেসিডেন্টের বেইস বা কট্টর সমর্থক বললে ভুল করা হবে না। শুধু তা–ই নয়, গত চার বছরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টিকে তাঁর হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছেন—দলে এখন এমন কোনো নেতা নেই, যিনি তাঁর কাজের ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য পর্যন্ত করতে রাজি হবেন। এটা তিনি আদর্শ বা কাজ দিয়ে করেননি, কার্যত অপমান করার হুমকি এবং ধমক দিয়ে করেছেন। বিভিন্ন প্রশ্নে দলের এত দিনের আদর্শিক অবস্থানকে তিনি আরও দক্ষিণপন্থী করতে পেরেছেন। দেশের রক্ষণশীলেরা তিন দশক ধরে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, ট্রাম্প তা বাস্তবায়ন করেছেন—বিচার বিভাগের প্রায় সর্বত্র কট্টর রক্ষণশীল বিচারকদের আসীন করেছেন, সুপ্রিম কোর্টে রক্ষণশীলদের আধিপত্য এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে তা আগামী কয়েক দশক ধরে অব্যাহত থাকবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দেশের উগ্র দক্ষিণপন্থীদের উসকানি দিয়েছেন। ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে তাঁর কথাবার্তা, আচার-আচরণ। গোটা দেশে একধরনের মেরুকরণ করতে সক্ষম হয়েছেন, অভিবাসীদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলেছেন, দেশকে বিভিন্নভাবে বিভক্ত করেছেন এবং শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদেরকে দেশের সমাজ-রাজনীতিতে একধরনের গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছে, তাঁদের হয়েই কথা বলেছেন, যা এমনকি তাঁদেরও আশাতীত।

এই ধরনের জনতুষ্টিবাদী একজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করা দুরূহ। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য করোনাভাইরাসের বিপর্যয়ের আগ পর্যন্ত বড় একটি অস্ত্র ছিল, দেশের অর্থনীতির ইতিবাচক অবস্থা। যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনীতি যখন ভালো, তখন একজন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে পরাজিত করার ঘটনা বিরল। ট্রাম্প তাঁর পূর্বসূরির কাছ থেকে যে অর্থনীতি পেয়েছিলেন, তাকেই এগিয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প দেখাতে পেরেছিলেন যে তাঁর সময়ে অর্থনীতি ভালো হয়েছে। এখন অর্থনৈতিক সংকট গভীর কিন্তু তাঁর সমর্থকেরা এখনো মনে করেন যে তিনিই এই সংকট থেকে দেশকে বের করতে পারবেন।

এসব সত্ত্বেও বিশ্লেষকেরা কেউ বলছেন না যে প্রেসিডেন্ট পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পথে এগিয়ে আছেন; কমবেশি সবারই কথা, প্রেসিডেন্ট শেষ পর্যন্ত একটা চমক দেখাবেন। কারণ, এখন পর্যন্ত জনমত জরিপগুলো ট্রাম্পের জন্য এমন কোনো ইঙ্গিত দেয় না যে তিনি এগিয়ে আছেন। ২০১৬ সালে যেসব রাজ্যে তিনি সহজেই বিজয়ী হয়েছিলেন, সেখানেও তাঁকে লড়তে হচ্ছে, প্রচার চালাতে হচ্ছে। রিপাবলিকানদের ঘাঁটি বলে পরিচিত অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, এমনকি টেক্সাসও এখন লড়াইয়ের ময়দানে পরিণত হয়েছে। এটা প্রায় নিশ্চিত যে ডেমোক্র্যাটদের নীল দেয়ালের প্রধান দুই রাজ্য উইসকনসিন, মিশিগান তাঁর হাত গলিয়ে বেরিয়ে গেছে। পেনসিলভানিয়ার অবস্থা তাঁর অনুকূলে নয়, তা ধরাছোঁয়ার বাইরে না গেলেও।

ট্রাম্পের এ অবস্থার অন্যতম কারণ যে করোনাভাইরাস বিষয়ে তাঁর অবস্থান, তা নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। তিনি নিজে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও যে তিনি না দেখালেন আক্রান্ত ও নিহত ব্যক্তিদের প্রতি সমবেদনা, না নিলেন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ। গত দুই সপ্তাহে একধরনের বেপরোয়া ভাব নিয়ে যেভাবে তিনি বিভিন্ন রাজ্যে সমাবেশ করছেন, সেটা তাঁর সমর্থকদের উজ্জীবিত করছে, কিন্তু সেটা অন্য ভোটারদের কাছে ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে না। সম্প্রতি করা এক জরিপে দেখা গেছে, অ্যারিজোনায় ৫৬ শতাংশ বলেছেন যে এতে ট্রাম্পের ব্যাপারে তাঁদের ধারণা ইতিবাচক হয়নি, ফ্লোরিডায় ৫৮ শতাংশ, মিশিগানে ৫৭ শতাংশ, নর্থ ক্যারোলাইনায় ৫৪ শতাংশ উত্তরদাতার মত তা–ই। যাঁরা একে ইতিবাচক মনে করেছেন, তাঁদের সংখ্যা অ্যারিজোনায় ১৯ শতাংশ, ফ্লোরিডায় ১৬ শতাংশ, মিশিগানে ১৭ শতাংশ এবং নর্থ ক্যারোলাইনায় ১৯ শতাংশ। তিনি আশা করেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টে একজন রক্ষণশীল বিচারক নিয়োগ তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়াবে; জরিপগুলোয় এর ফলে কোনো রকমের পরিবর্তন দেখা যায়নি।

কিন্তু ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় বিপদ হয়েছে এই কারণে যে তাঁর প্রতিপক্ষ জো বাইডেন এই নির্বাচনকে ট্রাম্পের ব্যাপারে গণভোটে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন। করোনাভাইরাসের কারণে, প্রেসিডেন্টের আচরণের কারণে সেটা সহজেই করা সম্ভব হয়েছে। ট্রাম্পের নির্বাচনী কৌশলের আরেকটি দিক হচ্ছে, তিনি কখনোই জো বাইডেনকে আলোচনার বিষয়ে পরিণত করতে পারেনি। গত গ্রীষ্মকালে দেশের বিভিন্ন শহরে পুলিশি নিপীড়ন ও নাগরিকদের সমানাধিকারের দাবিতে আন্দোলনের সময় সংগঠিত দাঙ্গা-হাঙ্গামার সঙ্গে বাইডেন এবং ডেমোক্র্যাটদের যুক্ত করতে চেষ্টা করেন।

নিজেকে দেখাতে চান আইনশৃঙ্খলার পক্ষের প্রার্থী হিসেবে। কিন্তু তাতে তিনি সক্ষম হননি। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর এই কৌশল বদলাতে হয়। তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে বাইডেন হচ্ছেন ‘গোপন সমাজতন্ত্রী’—এই প্রচেষ্টায় তিনি হয়তো হিস্পানিকদের একাংশের মধ্যে কিছুটা সফল হয়েছেন। সেটা যথেষ্ট কি না, তা নির্বাচনের ফলে দেখা যাবে। কিন্তু বড়সংখ্যক ভোটারের কাছে তা হালে পানি পায়নি। প্রথম বিতর্কে তাঁর বেপরোয়া আচরণ তাঁর জন্য ভালো ফল আনেনি।

জর্জিয়ার আটলান্টা নগরীতে ২৭ অক্টোবর নির্বাচনী সমাবেশে জো বাইডেন
ছবি: রয়টার্স

এসবের বিপরীতে জো বাইডেন এটা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন, এই নির্বাচন ট্রাম্পকে হারানোর নির্বাচন। নির্বাচনকে তিনি পরিণত করেছেন রেফারেন্ডামে। গোড়া থেকেই তিনি চেষ্টা করেছেন নিজেকে ট্রাম্পের ঠিক বিপরীত চরিত্র হিসেবে হাজির করতে, তাতে তিনি সফল হয়েছেন। দেশ পরিচালনায় তাঁর অবস্থান যে ট্রাম্পের বিপরীতে, সেটা সহজেই বোঝানো যেত, কিন্তু বিভিন্ন সময়ে তিনি ব্যক্তি হিসেবে তাঁদের পার্থক্যটি এতটাই গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছেন, যা দলনিরপেক্ষ ভোটারদের কাছে আবেদন রাখতে সক্ষম হয়েছে; বিজয়ের জন্য তাঁদের দলে টানা তাঁর দরকার। হিলারি ক্লিনটন শেষ মুহূর্তে তাঁদের এক বড় অংশের সমর্থন হারানোর কারণেই তিনটি অঙ্গরাজ্যে পরাজিত হয়েছিলেন।

বাইডেনের জন্য আরেকটি বিষয় ছিল এই, ২০১৬ সালে যাঁরা হিলারি ক্লিনটনকে ভোট দেবেন না বলে ভোটই দেননি, তাঁদের নির্বাচন বিষয়ে উৎসাহী করে তোলা। এখন পর্যন্ত আগাম ভোটের যে হিসাব দেখা যাচ্ছে, তা ইতিমধ্যেই ৮০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। এটি প্রমাণ করে, এদের একটি অংশ ভোটকেন্দ্রে আসতে শুরু করেছেন। বাইডেন তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে একজন মধ্যপন্থীকে বেছে নিয়েছেন, তাতেও বোঝা গেছে যে তিনি এমন ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে চাননি, যাতে তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়েই আলোচনা চলতে থাকে। ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কৃষ্ণাঙ্গ নারী প্রার্থী মনোনয়নের মধ্য দিয়ে দলের অভ্যন্তরে ও বাইরে তিনি অনেকটাই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছেন। এসব কৌশল তাঁকে যেসব সুবিধা দিয়েছে, তার ফল দেখা যাচ্ছে, তিনি ব্যাটলগ্রাউন্ড বলে পরিচিত রাজ্যগুলোর অধিকাংশেই এগিয়ে আছেন। কিন্তু এখনো তিন দিন বাকি; নির্বাচনের আগে একটি দিনও অনেক দীর্ঘ সময়।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর।