রপ্তানির সম্ভাবনা অনেক, বাস্তবতায় ঘাটতি

সাভারের আশুলিয়ায় একটি গার্মেন্টসে কাজে ব্যস্ত পোশাক শ্রমিকেরা।প্রথম আলো ফাইল ফটো

২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমাদের শুধু তৈরি পোশাক রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছানোর কথা ছিল। সব মিলিয়ে ২০২১ সালে রপ্তানির প্রাক্কলন ছিল প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার। কোভিড-১৯ অতিমারি মোকাবিলা করে এটি যদি সব মিলিয়ে আগামী বছর ৪২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে, তাতেই নাকি আমাদের খুশি থাকার কথা। অন্যদিকে অনেকেই বলছেন, ২০২৪ সাল নাগাদ আমরা একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতি হয়ে গেলে ২০২৭ সাল নাগাদ ভর্তুকি বা প্রণোদনা প্রত্যাহারের ফলে আমাদের রপ্তানি প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার কমে যাবে।

চলতি বছরের শুরুতেই দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে কোভিড-১৯-এর প্রভাব পড়তে শুরু করে। টালমাটাল পরিস্থিতি কাটিয়ে জুলাইয়ে চলতি অর্থবছরের শুরুতেই ধনাত্মক প্রবৃদ্ধিতে ফিরে আসে রপ্তানি খাত। এর পরের দুই মাসে সে ধারা বহাল থাকলেও অক্টোবরে আবারও পতন হয়েছে রপ্তানিতে। অক্টোবরে দেশের রপ্তানিতে পতন হয়েছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ শতাংশের বেশি। বিষয়টি উদ্বিগ্ন করে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের। তাঁরা বলছেন, অতিমারির প্রভাব কাটিয়ে সেখান থেকে পুনরুদ্ধারের আশা তৈরি হলেও এ পতনের কারণে তা আবারও পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

গত অর্থবছরের প্রায় পুরোটাই নেতিবাচক ধারায় ছিল দেশের রপ্তানি খাত। এর মধ্যেই অতিমারির প্রাদুর্ভাবের কারণে মার্চে এ নেতিবাচক ধারা মারাত্মক আকার ধারণ করে। এপ্রিলেও তা হ্রাস পায় ব্যাপক হারে। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি দেখা যায় মে মাসে, যা জুনেও অব্যাহত ছিল। তবে সার্বিকভাবে গোটা ২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানি কমে যায় ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাসে প্রবৃদ্ধি হলেও তা ছিল ১ শতাংশের নিচে। তবে আগস্টে প্রবৃদ্ধি হয় ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ নিয়ে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত ছিল। যেমনটি বলেছি, অক্টোবরে আবারও ঋণাত্মক হয়েছে প্রবৃদ্ধি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, অক্টোবরে দেশের রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।

অক্টোবরে একক মাস হিসেবে রপ্তানি হ্রাস পেলেও অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সার্বিকভাবে কিছুটা ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির দেখা পেয়েছে রপ্তানি খাত, যদিও তা ১ শতাংশের নিচে। ইপিবির প্রতিবেদন বলছে, অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বাংলাদেশ থেকে মোট ১ হাজার ২৮৪ কোটি ৪৬ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৭২ কোটি ১২ লাখ ২০ হাজার ডলার।

ইপিবির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের শুধু জুলাই মাসে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ছিল। ডিসেম্বর মাস ছাড়া আগস্ট থেকে জুন সবগুলো মাসেই রপ্তানি নেতিবাচক ছিল। এরপর চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে অর্থাৎ টানা ছয় মাস পর রপ্তানি বেড়েছে।

আমরা প্রায় মুখস্থ জানি, দেশের রপ্তানি খাতের সিংহভাগই আসে তৈরি পোশাক থেকে। ইপিবির হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে, জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের মোট রপ্তানিতে তৈরি পোশাকের অংশ ছিল প্রায় ৮১ শতাংশ। মূলত তৈরি পোশাক পণ্যের রপ্তানি কমার প্রতিফলনই দেখা যাচ্ছে সার্বিক রপ্তানিতে।

গত অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ। টানা ৭ মাস পতনের পর চলতি বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে কিছুটা ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসে খাতটি। এরপর আবার অক্টোবর মাসে তৈরি পোশাকের রপ্তানি হ্রাস পায় ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ, যা খাতটির বৈশ্বিক চাহিদা ও বাণিজ্য পুনরুদ্ধার নিয়ে শঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছে।

ইউরোপে পোশাকের চাহিদা যদি আরও জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে, তাহলে আমাদের জন্য খাপ খাইয়ে নেওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়বে। ইউরোপ যেহেতু আমাদের প্রধান বাজার, এ কারণেই বিষয়টি বেশ উদ্বেগজনক।

পরিসংখ্যান বলছে, অক্টোবরে রপ্তানির এ বড় পতনের কারণেই চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ঋণাত্মক ১ দশমিক ২ শতাংশে। এ প্রসঙ্গে খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ওভেন পোশাক রপ্তানি কমার কারণেই সার্বিকভাবে তৈরি পোশাকের মোট রপ্তানিতেও পতন হয়েছে। আলোচ্য সময়ে নিটওয়্যারের রপ্তানিতে ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ওভেন পোশাক রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অক্টোবরে যেখানে নিটওয়্যারের রপ্তানি কমেছে ২ দশমিক ১৯ শতাংশ, সেখানে ওভেন পোশাক রপ্তানি কমেছে ১৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

অক্টোবর মাসের দেশভিত্তিক রপ্তানি তথ্য পাওয়া যায়নি, তবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরের তথ্যে দেখা গেছে, অপ্রচলিত বাজারগুলোয় রপ্তানি নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে বেশি। আবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রে স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি আমাদের রপ্তানিকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। এখন যেহেতু ইউরোপে করোনার প্রকোপ নতুন করে বাড়তে শুরু হয়েছে, সে কারণে ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম ও গ্রিসসহ বেশ কিছু দেশ লকডাউন এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। ইউরোপে পোশাকের চাহিদা যদি আরও জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে, তাহলে আমাদের জন্য খাপ খাইয়ে নেওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়বে। ইউরোপ যেহেতু আমাদের প্রধান বাজার, এ কারণেই বিষয়টি বেশ উদ্বেগজনক।

কেউ কেউ মনে করেন, রপ্তানি মূল্যে চাহিদা পতনের প্রভাব এনবিআরের তথ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে অক্টোবরে পোশাকের মূল্য গড়ে ৪ দশমিক ১৫ শতাংশ হারে কমেছে। জুলাই-অক্টোবর সময়সীমায় তা হ্রাস পেয়েছে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। কোভিড-১৯-এর কারণে আমাদের কারখানাগুলোর বেশির ভাগই আর্থিক ক্ষতিতে পড়েছে। যেখানে গোটা শিল্পেই এখন হেলথ প্রটোকল বজায় রাখতে গিয়ে নির্দিষ্ট কিছু ব্যয় ধরে রাখতে হচ্ছে, সেখানে মূল্যের এ পতন নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে।

চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো ও নামানোর এই দৃশ্য নিত্যদিনের।
প্রথম আলো ফাইল ফটো

করোনার প্রভাবে দেশের তৈরি পোশাক খাত প্রথমে কাঁচামালের সরবরাহ-সংকটে পড়ে। কারণ দেশে তৈরি পোশাক খাতের ওভেন পণ্যের আনুমানিক ৬০ শতাংশ কাপড় আমদানি হয় চীন থেকে। দেশটি থেকে নিট পণ্যের কাঁচামাল আমদানি হয় ১৫-২০ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে ধীরগতিতে কাঁচামাল সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও রপ্তানি গন্তব্যগুলোয় আবার চাহিদার ঘাটতি দেখা দেয়।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য আমেরিকা ও ইউরোপ মহাদেশভুক্ত প্রতিটি দেশকেই কোভিড-১৯-এর ব্যাপক প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করেছে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাতিল-স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশের ৮০ শতাংশের বেশি পুনর্বহাল হলেও সেগুলোর সময়সীমা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। কারখানামালিকেরা বলছেন, বাতিল বা স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশগুলোর কিছু ফিরে এসেছে। আবার নতুন ক্রয়াদেশও পেতে শুরু করেছে কারখানাগুলো। কিন্তু তা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক কম। অনেকেই বলছেন, নভেম্বরের পর রপ্তানিতে আবার সংকট দেখতে পাচ্ছেন।

বাংলাদেশের রপ্তানি বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতকে ভর করে প্রায় তিন দশক ধরেই বেড়ে চলেছে। তবে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এমনকি ভারত তাদের রপ্তানি বৃদ্ধি বা নিদেনপক্ষে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতাশীল হয়ে ওঠার জন্য যে ধরনের প্রতিযোগিতা করছে বা সংস্কারে হাত দিচ্ছে, সে তুলনায় আমাদের উদ্যোগ খুবই নগণ্য, তা সরকারের হোক কিংবা ব্যক্তিখাতের। আমাদের রপ্তানি খাত বেশির ভাগই সরকারের বিশেষ বিশেষ প্রণোদনা বা আপৎকালীন সহায়তানির্ভর। শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, আমদানি-রপ্তানি কাঠামোর পুনর্মূল্যায়ন এমনকি অর্থায়ন কাঠামোতেও তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। ব্যবসা থেকে গ্রাহক/বিজনেস টু কনজিউমার পর্যায়েও তেমন উন্নতি ঘটেনি। প্রচলিত কাঠামোয় রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ থাকলেও রপ্তানির প্রাপ্তব্য অর্থ পাওয়ার কোনো গ্যারান্টি নেই। ঋণের ব্যবস্থা থাকলেও সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে ঝুঁকি মোকাবিলার সহায়তা নেই। রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ আর নতুন বাজার খুঁজে বের করার উদ্যোগেও ঘাটতি রয়েছে।

শুধু সস্তা শ্রম ও নিম্ন প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে বাংলাদেশের রপ্তানিতে উল্লম্ফন তাই প্রায় অসম্ভব বলেই অনেকের ধারণা। শুধু সম্ভাবনা থাকলেই হবে না, সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য চাই সমন্বিত ও সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ।

মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক