রাষ্ট্রপতির বক্তব্য আনুগত্যমূলক

রাজনীতি
রাজনীতি

সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচন ও সংলাপ নিয়ে কিছু বক্তব্য দিয়েছেন, যা রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে৷ এ বিষয়ে দুজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর অভিমত এখানে দেওয়া হলো:
নির্বাচন ঠিকমতো হয়েছে কি হয়নি, জনগণ মেনে নিয়েছে কি নেয়নি; রাষ্ট্রপতির এসব নিয়ে সিদ্ধান্তসূচক কথা বলার কথা নয়৷ আর তিনি কথাটা বলেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের কাছে৷ তিনি যা বলেছেন, যেখানে বলেছেন, যেভাবে বলেছেন, তা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত৷ আমাদের দেশে সবকিছুরই অবনতি হচ্ছে; রাষ্ট্রপতি পদ ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও সেই অবনতি দেখা যাচ্ছে৷
রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে, রাজনৈতিক সংস্কৃতিও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে৷ আমাদের রাষ্ট্রপতি বর্ষীয়ান পার্লামেন্টারিয়ান ছিলেন, গণতন্ত্রের জন্য তাঁর অবদান রয়েছে৷ গণতন্ত্রের রীতিনীতি তাঁর থেকে আর কে ভালো জানবে? তাঁর এই আচরণ গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেবে না, পিছিয়ে দেবে৷
বান কি মুনের সামনে রাষ্ট্রপতির এমন দলীয় রাজনৈতিক অবস্থান প্রকাশ পাওয়ায় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করি৷ বান কি মুন যে তাঁর কথাকে মেনে নেননি, তার প্রমাণ দেখা যায় পরের বিবৃতিতে৷ সেখানে তিনি সংসদের বাইরের বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ ও সমঝোতার আহ্বান জানিয়েছেন৷ যেখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি স্পষ্ট করে বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে এবং জনগণ তা মেনেও নিয়েছে এবং দেশে স্থিতিশীলতাও বিরাজ করছে; সেখানে বান কি মুনের পক্ষ থেকে সংসদের বাইরের বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতার কথা বলা মানে তিনি মনে করছেন সংকট রয়ে গেছে৷ এই বিবৃতিই প্রমাণ করে দেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক স্তরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷
নির্বাচন আমাদের দেশের মানুষ মেনে নেয়নি; আন্তর্জাতিকভাবেও নেয়নি৷ সেটা রাষ্ট্রপতি ভালো করেই জানেন৷ যে নির্বাচনে ১০-১৫ শতাংশ ভোট পড়ে, সে রকম নির্বাচনকে নির্বাচন কমিশনও সুষ্ঠু বলতে চায় না৷ জনগণ মেনে নিয়েছে—এটা তিনি কিসের ভিত্তিতে বললেন? এ ব্যাপারে কি কোনো জনমত জরিপ করা হয়েছে? তাঁর বক্তব্যের ভিত্তি সরকারি দলের প্রতি আনুগত্য ছাড়া তো আর কিছু দেখছি না৷
আমাদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের যে পন্থা, তাতে আমরা হয় বিএনপির রাষ্ট্রপতি নয়তো আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতি পাই৷ এই পন্থা হলো নেতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের প্রবণতা৷ তাঁরা হয়তো মনে করেন প্রধান নেতার সুনজরে না থাকলে, তাঁদের যা কিছু অর্জন সব বিফলে যাবে৷ কেবল রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদই নন, আগের দুজন রাষ্ট্রপতিও এ রকম দলীয় পক্ষপাত দেখিয়েছিলেন৷ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানও বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ছিলেন, অথচ তিনি ১৯ জন ফাঁসির আসামিকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন৷ সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদও নিরপেক্ষ থাকতে ব্যর্থ হয়েছিলেন৷
যাঁরা দীর্ঘদিন রাজনীতি করে এসেছেন, তাঁরা উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করবেন, জাতিকে ভরসা দেবেন, ঐকমত্যের প্রতীক হবেন৷ এটাই আমরা আশা করি৷ ওই মাপের মানুষেরা যদি বিপরীত পথে চলেন, তাহলে নতুন নেতারা কী করবেন? আবদুল হামিদ যখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন, তখন বিএনপিও তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিল৷ স্পিকার হিসেবে তিনি অসাধারণ ছিলেন৷ তাই তঁার কাছে সবারই অন্য রকম প্রত্যাশা ছিল৷ কিন্তু তিনি অপ্রয়োজনীয়ভাবে নিজেকে বিতর্কিত করে ফেলছেন৷
এ অবস্থায় সমঝোতার সত্যিকার আশা দেখি না৷ রাজনীতিবিদেরা নানা স্তরে কথা বলবেন, মনোভাব বিনিময় করবেন; ব্যক্তিগত পর্যায়ে সংলাপ চালাবেন৷ কিন্তু সেটাও আমাদের দেশে হয় না৷ কাজেই শক্তি প্রদর্শনই হয়ে দাঁড়িয়েছে উদ্দেশ্যসাধনের প্রধান উপায়৷ এখানে যে শক্তি দেখাতে পারবে, সে-ই এককভাবে সবকিছু করতে চাইবে৷ সমঝোতা হলে হয় বাইরের দেশের লোকের দ্বারা৷ বাংলাদেশের রাজনীতি বাংলাদেশের জনগণের হাত থেকে বেরিয়ে গেছে৷ এখন বাইরের শক্তিই সবকিছু ঠিক করে দেয়৷
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে মহাজোট সরকারের নেতারা বলেছিলেন, এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচন৷ প্রকৃত নির্বাচন নিয়ে এর পরে কথা হবে৷ কিন্তু তাঁরা এখন বলছেন, ২০১৯ সালের তিন মাস আগে নির্বাচন নিয়ে কথা হবে—তার আগে নয়৷ যে কথা বলে তাঁরা নির্বাচন করেছিলেন, অংশগ্রহণহীন নির্বাচন মেনে নিতে বলেছিলেন, সেই কথা থেকে তাঁরা সরে এসেছেন৷ এটা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা৷ তাঁরা তাঁদের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছেন৷ প্রতিজ্ঞা করলে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে হয়, এটা আমরা শিশুদের শিখাই৷ এটা হলো ছলা-কলা-কৌশলের রাজনীতি৷ যেকোনো উপায়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার রাজনীতি৷
রাষ্ট্রপতি দেশে স্থিতিশীলতা দেখতে পাচ্ছেন৷ সত্যি যে আপাতভাবে জ্বালাও-পোড়াও-অবরোধ নেই৷ সেদিক থেকে দেশ স্থিতিশীল৷ কিন্তু ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা যথেষ্ট আছে৷ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই খারাপ৷ মানুষের মধ্যে অনিশ্চয়তা কাজ করছে৷ অর্থনীতিতে বিনিয়োগ কমে গেছে৷ এটা স্থিতিশীলতা নয়, এটা স্থবিরতা৷ স্থবিরতাকে অনেক সময় স্থিতিশীলতা বলে ভুল হয়৷ আমি বলব, এটা ঝড়ের আগের থমথমে ভাব৷
ড. দিলারা চৌধুরী: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অধ্যাপক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়৷