সম্মান

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

রাত ঠিক সাড়ে নয়টায় কারওয়ান বাজারে আইসিটির এক ফেসবুক লাইভে যেতে হবে। বাজে এখন রাত পৌনে নয়টা। আর আমি শাহবাগে। এখান থেকে কারওয়ান বাজার যাওয়ার জন্য সিএনজিচালককে বললাম (অনুরোধ করলাম), ‘কারওয়ান যাবেন, ভাইজান?’

সিএনজিচালক চরম ভাবসহকারে বললেন, ‘যামু না!’

‘১০০ টাকা দিব।’

‘যামু না তো কইলাম!’

‘২০০ টাকা!’

জবাব দিলেন না, শুধু মাথা নাড়ালেন যে যাবেন না।

‘৩০০ টাকা!’

‘ওই দিকে আমি যামু না!’

‘৪০০ টাকা!’

‘কইলাম তো ওই দিকে যামু না!’

‘কোন দিক যাবেন ভাই? আমি সেই দিকেই যাব...’

কোনো উত্তর নেই।

‘চলেন না রে ভাই, আমার একটু জরুরি অবস্থা হয়ে গেছে।’

ইতিমধ্যে তিনি আমাকে পুরোপুরি মেপে ফেলেছেন। অন্য আরেক খদ্দরের সঙ্গে কথা বলা শুরু করে দিয়েছেন।

‘আপনার পা ধরি?’

এই বলে আমি তাঁর পা ধরার ভান করে একটু সামনের দিকে নুইয়ে পড়লাম।

কোনো পাত্তা নেই।

‘আচ্ছা ভাই, আমি আপনাকে ৫০০ টাকা দেব আর আপনার কোলে বসে আপনার গালে একটা চুমুও খাব...’

এবার তিনি নির্ঘাত ভয় পেলেন এবং মনে মনে শোকর গুজার করলেন। আমাকে না নেওয়ার সিদ্ধান্তকে তারিফ না করে পারলেন না।

আমি হেঁটে বা দৌড়ে কারওয়ান বাজারের দিকে রওনা দিলাম। কিছুদূর যেতেই ওই সিএনজি আমার পাশে দাঁড়াল আর ভেতরের যাত্রী এক ভদ্রলোক আমাকে বললেন, ‘ওঠেন, আমি আপনাকে কারওয়ান বাজারে নামিয়ে দেব।’

আমি ইতস্তত করলাম। মলম/ধুতরা/অজ্ঞান/ঠেক পার্টির কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমার হাতে সময় কম। হেঁটে বা দৌড়ে গেলেও সময়মতো পৌঁছাতে পারব না। তা ছাড়া ভদ্রলোক ওই জাতীয় হলে মনে হয় তাকে সামলাতে পারব—শুধু ডান দিকে একটু হেলান দিয়ে আমার শরীরের ২০৫ পাউন্ড ওজনের কিছু ভগ্নাংশও যদি তার ওপর ফেলা যায়, তাতে তিনি মোটামুটি (হ্যাঁ, ‘মোটা’ ‘মুটি’) অর্ধভর্তা হয়ে যাবেন।

সুযোগ নিয়ে নিই। আল্লাহ মালিক। মলম খেয়ে অজ্ঞান হয়ে না হাজির হওয়া, ফেসবুক লাইভে দেরি করে হাজির হওয়ার চেয়ে উত্তম।

এদিকে সিএনজিচালক ক্ষুব্ধ হয়ে গেলেন, শুধু এক উন্মাদকে সিএনজিতে তুলে নেওয়ার জন্যই নয়, ‘কইলাম না আমি কারওয়ান বাজার দিয়া যামু না!’

আবার সেই ভাঙা রেকর্ড...

ভদ্রলোক সিএনজিচালককে ধমক দিয়ে বললেন, ‘ওই মিয়া! আপনাকে ৪০০ টাকা দিয়ে মিরপুর নিয়ে যাচ্ছি—আমি যেখান দিয়ে যেতে বলব, সেখান দিয়েই যাবেন!’

৪০০ টাকা দিয়ে শাহবাগ থেকে মিরপুর? আর আমি শুধু শাহবাগ থেকে কারওয়ান বাজারে ৫০০ টাকা দিয়ে যাওয়ারই নয়, তাঁর কোলে বসে গালে চুমু খাবার প্রস্তাবও করেছিলাম...

সিএনজিতে উঠে পড়লাম। অনিচ্ছাসত্ত্বেও চালক কারওয়ান বাজারের দিকে চলেছেন। (বড় প্রশ্ন, সিএনজিচালক এই ভদ্রলোককে মিরপুর নিয়ে যেতে রাজি হয়েছেন, আর প্রথমেই আমাকে অন্তত বাংলামোটর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য তো রাজি হতে পারতেন!)

ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দিলাম আর ভাড়া ভাগাভাগি করার প্রস্তাব দিলাম। তিনি হেসে বললেন, ‘আরে, নাভীদ ভাইয়ের জন্য এতটুকু করতে পারব না?’

আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, ‘আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন? এই অন্ধকারের মধ্যে!’

‘না চিনতে পারিনি। কিন্তু আপনি যখন চালকের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলেন, আপনার কণ্ঠস্বর শুনে চেনা চেনা লাগছিল। আর আপনি যখন বললেন ‘কোলে বসে গালে চুমু খাব...’ তখন বুঝলাম এটা নির্ঘাত নাভীদ মাহবুব, কারণ তাঁর মুখ ছাড়া অন্য কারও মুখ থেকে এ ধরনের (উন্মাদ মার্কা) কথা বের হতে পারে না...”

তিনি আমাকে কারওয়ান বাজারে নামিয়ে দিলেন। তাঁর ভিজিটিং কার্ড দিলেন। অস্ট্রেলিয়ার পার্থে থাকেন। পুরকৌশলে পিএইচডি করা, আর সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁর স্ত্রী একই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক—তিনিও স্থাপত্যবিদ্যায় পিএইচডি করেছেন।

‘আমরা টোনাটুনি পার্থে বসে আপনার টেলিভিশন অনুষ্ঠান উপভোগ করি।’

করপোরেট জগতের মোটা বেতনের জীবন ছেড়ে প্রফেশনাল কুতকুতিওয়ালা হয়েছি। স্বেচ্ছায়। আজ পকেটও তুলনামূলকভাবে খালি। তাই গাড়ি ছেড়ে সিএনজি চড়তে হয়, সিএনজিচালকের ঝাড়িও খেতে হয়। তবে করপোরেট কর্মকর্তা হলে হয়তো আজকের এই বিচিত্র অভিজ্ঞতা, সম্মান, আর ভালোবাসা পেতাম না। জীবনটা এ কারণেই এত রঙিন...

লেখক: একজন কমেডিয়ান, এটিএন বাংলার দ্য নাভীদ মাহবুব শো-এর উপস্থাপক, যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্ড মোটর কোম্পানির সাবেক প্রকৌশলী এবং আইবিএম বাংলাদেশের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক