জুলাই সনদ: বাস্তবায়নের উপায় দেখে সিদ্ধান্ত নেবে দলগুলো
১৫ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হবে বলে জানিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
তবে সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে এখন পর্যন্ত সুপারিশ চূড়ান্ত করেনি কমিশন। সনদ বাস্তবায়নে গণভোট নিয়ে ঐকমত্য থাকলেও গণভোটের ভিত্তি, সময় ও পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক মতবিরোধ আছে।
এমন পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত সব দল সনদে সই করবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়। কমিশনের সুপারিশে বাস্তবায়নের উপায় বিশেষ করে গণভোটের সময় ও ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে কী থাকছে—এগুলো আগে দেখতে চায় দলগুলো। এসবের ওপর সনদে সই করা না করার বিষয়টি নির্ভর করছে বলে দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, অধ্যাপক ও আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ প্যানেল যে মতামত দিয়েছে, সেটা ভিত্তি ধরছে কমিশন। প্রয়োজনে এটি আরও সুনির্দিষ্ট ও কিছুটা বিস্তারিত করা হবে।
ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, গণভোটের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে মতভিন্নতা থাকলেও এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য হওয়ায় সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি হিসেবে এটাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে কমিশন। এ ক্ষেত্রে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, অধ্যাপক ও আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ প্যানেল যে মতামত দিয়েছে, সেটা ভিত্তি ধরছে কমিশন। প্রয়োজনে এটি আরও সুনির্দিষ্ট ও কিছুটা বিস্তারিত করা হবে।
সূত্র জানায়, গণভোটের সময়ের বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করছে কমিশন। আগামী রোববারের মধ্যে বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ দেবে কমিশন। বাস্তবায়নের সুপারিশ সনদের অংশ হবে না।
গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ আগামী ১৫ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় স্বাক্ষরিত হবে। স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কার্যালয়ের সভাকক্ষে কমিশনের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়।
১৫ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হবে। এর আগেই কমিশন জুলাই সনদের বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দেবে। সেখানে বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত থাকবে।অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সহসভাপতি, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন
বৈঠকে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান ও মো. আইয়ুব মিয়া উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও সভায় অংশ নেন।
গত বছরের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। সেগুলো হলো সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। গত ফেব্রুয়ারিতে এই কমিশনগুলো তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব সরকারের কাছে জমা দেয়।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই পর্বের আলোচনায় ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে কিছু প্রস্তাবে কোনো কোনো দলের ভিন্নমত আছে। এই ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। প্রথম পর্বে ৩৩টি এবং দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দল আলোচনায় অংশ নেয়।
তবে সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের পাঁচ দিন আলোচনা হলেও ঐকমত্য হয়নি। সর্বশেষ গত বুধবার রাতে আলোচনায় দলগুলোর অনড় অবস্থানের মুখে ঐকমত্য কমিশন জানায়, বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত সমন্বয় করে বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারকে সুপারিশ দেবে কমিশন।
আলোচনায় ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে কিছু প্রস্তাবে কোনো কোনো দলের ভিন্নমত আছে। এই ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। প্রথম পর্বে ৩৩টি এবং দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দল আলোচনায় অংশ নেয়।
আগে সুপারিশ দেখতে চায় দলগুলো
শুরু থেকেই বিএনপি বলে আসছে, জুলাই সনদ নিয়ে সংবিধান আদেশ জারি করা যাবে না, সনদকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়া যাবে না। দলটি বলছে, আদেশ নয় বরং জুলাই সনদ নিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা যায়। তার ভিত্তিতে একটি নতুন অধ্যাদেশ করে গণভোট করা যায়। সনদের অঙ্গীকারনামায় যুক্ত করা হবে যে ভিন্নমতগুলোর বিষয় দলগুলো নির্বাচনী ইশতাহারে উল্লেখ করবে। নির্বাচিত হলে তারা ভিন্নমত অনুসারে সনদ বাস্তবায়ন করতে পারবে। সর্বশেষ বুধবারের আলোচনাও বিএনপি তাদের এই অবস্থান তুলে ধরে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির অবস্থানের সঙ্গে প্রায় সবাই একমত হয়েছে। তাঁরা জুলাই সনদকে যতটা সম্ভব আইনি ভিত্তি দেওয়া, এটি নিয়ে জনগণের সম্মতি নেওয়া এবং পরবর্তী সময়ে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার কথা যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেছেন। জনগণ নিশ্চয় সংস্কারের বিষয়ে বিএনপির আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা বুঝতে পেরেছে।
বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশ দেবে, তা বিএনপি মানবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কী সুপারিশ দেয়, তা দেখে এ বিষয়ে মন্তব্য করা যাবে।
যারা সংস্কার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়, তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে গণভোট চায়। আগামী নির্বাচন সংস্কারের ভিত্তিতে না হলে আগের মতোই হবে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, সংস্কার নিয়ে দীর্ঘ এক বছর কাজ করার পর যদি সরকার কিছু চাপিয়ে দেয়, সেটা কি জনগণ মানবে?সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ, জামায়াতে ইসলামী
জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) চায়, সংস্কার টেকসই করতে সংবিধান আদেশ না হলেও জুলাই বাস্তবায়ন আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট করতে হবে। আগামী জাতীয় সংসদকে দ্বৈত ভূমিকা পালনের ক্ষমতা দিতে হবে। ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলোও সনদ ও গণভোটে থাকতে হবে।
কমিশনের সুপারিশ জামায়াতে ইসলামী মেনে নেবে কি না এবং সনদে সই করবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ প্রথম আলোকে বলেন, কমিশনের সুপারিশে কী আসে, সেটা আগে দেখতে হবে। তারপর এ বিষয়ে মন্তব্য করা যাবে। তিনি বলেন, যারা সংস্কার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়, তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে গণভোট চায়। আগামী নির্বাচন সংস্কারের ভিত্তিতে না হলে আগের মতোই হবে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, সংস্কার নিয়ে দীর্ঘ এক বছর কাজ করার পর যদি সরকার কিছু চাপিয়ে দেয়, সেটা কি জনগণ মানবে?
এনসিপিও সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ আগে দেখতে চায়। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন প্রথম আলোকে বলেন, বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে কমিশনের কী সুপারিশ আসে, গণভোট কখন হবে, নোট অব ডিসেন্টের (ভিন্নমত) বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত আসে—এসব দেখে তাঁরা তাঁদের পরবর্তী অবস্থান জানাবেন।
ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত তারা মনে করছে, গণভোটে প্রশ্ন হতে পারে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন চান কি না। এ ক্ষেত্রে দুটি প্রশ্ন রাখার চিন্তা করা হচ্ছে। একটিতে থাকবে, যেগুলোতে ঐকমত্য আছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন চান কি না। আরেকটিতে থাকবে ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন চান কি না।
বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে কমিশনের ভাবনা
সনদে সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি ধাপের কথা বলেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সুপারিশ তৈরি করার ক্ষেত্রে কমিশন বিশেষজ্ঞদের মতামতকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কমিশনও মনে করে, একটি বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট করতে হবে। এ ছাড়া আগামী সংসদকে দ্বৈত ভূমিকা পালনের (সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও জাতীয় সংসদ) ক্ষমতা দিতে হবে এবং কত দিনের মধ্যে সংবিধান-সংস্কার করা হবে, তা-ও নির্ধারণ করে দিতে হবে।
ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত তারা মনে করছে, গণভোটে প্রশ্ন হতে পারে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন চান কি না। এ ক্ষেত্রে দুটি প্রশ্ন রাখার চিন্তা করা হচ্ছে। একটিতে থাকবে, যেগুলোতে ঐকমত্য আছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন চান কি না। আরেকটিতে থাকবে ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন চান কি না।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ১৫ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হবে। এর আগেই কমিশন জুলাই সনদের বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দেবে। সেখানে বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত থাকবে।