আমাদের এই অঞ্চলের জরিপ নিয়ে কিছুটা নেতিবাচক মনোভাব আছে আমার। জরিপের প্রক্রিয়াগত কোনো সমস্যা নেই। তারপরও কেন যেন মনে হয়, এই অঞ্চলের মানুষ জরিপে সত্য কথা বলে না। এমনকি নাম প্রকাশ না করার শর্তেও অনেক সময় সঠিক তথ্য দিতে চান না। এরপরও প্রথম আলোর জরিপে যে ফলাফল এসেছে, তা আমার ধারণার সঙ্গে অনেকটাই মেলে। আমার কাছে মনে হয়েছে যে এই জরিপে সঠিক তথ্যই উঠে এসেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে অনেকগুলো জরিপের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর ফলাফল দেখে আমি ২০২৪ সালে ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে করা জরিপগুলো বিশ্লেষণ করেছি। সব কটি জরিপেই কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট যত আসন পাবে বলে বলা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি আসন তারা পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে হওয়া জরিপের ফলাফলে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর পার্থক্য খুব কম এসেছে। এটি কতটা বিশ্বাসযোগ্য, সেই প্রশ্ন রয়ে গেছে। প্রথম আলোর জরিপটি এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম মনে হয়েছে।
জরিপের তথ্যমতে, ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ মনে করেন বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের। সে তুলনায় অনেক কম ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষের ধারণা, পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের।
আবার যখন প্রশ্ন করা হলো যে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হলে দেশের জন্য ভালো হবে, সে ক্ষেত্রে শফিকুর রহমানের পক্ষে জনমত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ। এই বিষয়ে তারেক রহমানের পক্ষে জনমত ৩৬ দশমিক ৯ শতাংশ। অতীতে বিএনপির শাসনামলে তারেক রহমানের ভূমিকা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। তিনি এর অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছেন। এরপরও ভালো প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নে তাঁর কিছুটা কম সমর্থনের পেছনে অতীতের সমালোচনা ভূমিকা রেখেছে।
বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচন যথাযথভাবে হয়নি। এবার যেমন বেশি বেশি জরিপ হচ্ছে, আগের তিন নির্বাচনে সেভাবে জরিপ হয়নি। ফলে অতীতের জরিপ নিয়ে বর্তমানকে বিশ্লেষণ করার সুযোগ নেই। বিগত তিনটি নির্বাচন সঠিকভাবে হয়নি বলে ভোটারের আচরণ সম্পর্কেও ধারণা নেই। এবার যে জরিপগুলো হচ্ছে, সেগুলো আগামী নির্বাচন ছাড়াও পরবর্তী অন্য নির্বাচনে মিলিয়ে দেখার সুযোগ হবে।
পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হলে তারেক রহমানই প্রধানমন্ত্রী হবেন—দল থেকে এমনটাই বলা হচ্ছে। এরপরও দলটির অসুস্থ চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অনেকেই পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখছেন। এটা হয়েছে তাঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও সহানুভূতি থেকে। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় মানুষ তাঁর প্রতি যে আবেগ দেখাচ্ছে, সেটা অভূতপূর্ব। আল্লাহ না করুক, তিনি যদি নির্বাচনের আগে মারা যান তাঁর প্রতি যে সমর্থন, তা বিএনপির দিকে যাবে। তারেক রহমানের প্রতি সমর্থন বাড়তে পারে। এ ছাড়া তিনি সুস্থ হয়ে নির্বাচনের মাঠে থাকলে, সেটাও বিএনপির পক্ষে যাবে। অর্থাৎ খালেদা জিয়ার প্রতি মানুষের ভালোবাসার বিষয়টি বিএনপি ও তারেক রহমানের জন্য ইতিবাচক হতে পারে।
৯২ শতাংশ মানুষ আগামী নির্বাচনে ভোট দেবেন বলে যে মত এসেছে, সেটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ, ১৭ বছর ধরে দেশে একটা গ্রহণযোগ্য ভোট হয়নি। ফলে দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থাকা মানুষের মধ্যে ভোট দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রবল, সেটা বোঝা যায়। যে অল্পসংখ্যক মানুষ ভোট দিতে আগ্রহী নন, তাঁরা হচ্ছেন আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক।
ভোট সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়া নিয়ে আশাবাদী মানুষ অর্ধেকের কিছু বেশি হওয়ার বিষয়টি অনুমেয়। কারণ, ভোট সুষ্ঠু করার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি নেই। তবে তাদের সক্ষমতা আছে কি না, সেই প্রশ্ন রয়েছে। দৈনন্দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাতেই সরকার বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। একসঙ্গে ৩০০ আসনে নির্বাচন, দলের সঙ্গে দল এবং দলের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে সরকার কতটা সক্ষম হবে, সেই প্রশ্ন মানুষের মনে থাকতেই পারে।
দল দেখে ভোট দেওয়ার প্রবণতা দেশে আছে। এটা হওয়াও খারাপ কিছু নয়। কারণ, দলই তো সরকার গঠন করবে। তবে আমার ধারণা, দল দেখে ভোট দেওয়ার প্রবণতা কমেছে। অতীতের নির্বাচনে বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থক ধরা হতো ৭০ শতাংশ। বাকি ৩০ শতাংশ সুইং ভোটার। অর্থাৎ আগে ৭০ শতাংশ মানুষ দল দেখে ভোট দিতেন। জরিপ দেখে মনে হচ্ছে, দল নিয়ে মানুষের যে ঘোর ছিল, তা কমেছে।
এটা ঠিক, ধর্মের প্রতি মানুষের অনুরাগ বাড়ছে। এটা এত বেশি হলে জামায়াতের নেতৃত্বে যে ইসলামপন্থী দলগুলোর জোট আছে, তাদের নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনা বেশি আসতে পারত। সেটা তো হয়নি।
দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের ধর্মভিত্তিক দলের প্রভাব বেড়েছে বলে মনে করা এবং ইসলামি আইন চালু হলে ভালো হবে—এমন মত বেশি হওয়ার বিষয়টি কতটা সত্য, তা আমি নিশ্চিত নই। তবে এটা ঠিক, ধর্মের প্রতি মানুষের অনুরাগ বাড়ছে। এটা এত বেশি হলে জামায়াতের নেতৃত্বে যে ইসলামপন্থী দলগুলোর জোট আছে, তাদের নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনা বেশি আসতে পারত। সেটা তো হয়নি। সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্ব না বৃদ্ধির পক্ষে অধিকাংশ মতের বাস্তবতা আছে। এমনিতেই আমাদের সমাজ পিতৃতান্ত্রিক, নারীবিদ্বেষী। এমনকি পশ্চিমা বিশ্বেও চাকরিবাকরিতে নারীদের এগিয়ে যাওয়াকে সমর্থন করা হয়। তবে রাজনৈতিকভাবে নারীর এগিয়ে যাওয়া অনেক সময় মেনে নেওয়া হয় না।