জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার লক্ষ্যে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নভেম্বরের শুরুতেই ভোটের তফসিল ঘোষণা করতে চাইছে তারা। এমন পটভূমিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন গত সোমবার। সেদিন তিনি প্রেস ব্রিফিং ডেকেছিলেন। কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার ভোটের পরিবেশসহ নির্বাচন সম্পর্কে কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, ভোটের পরিবেশ নেই বলে বিরোধী দলগুলো বক্তব্য দিচ্ছে, সেখানে ইসি কি ভোটের পরিবেশ নিয়ে কোনো কাজ করছে। জবাবে সিইসি বলেন, এটি খুব জটিল প্রশ্ন। তিনি এ মুহূর্তে উত্তর দিতে পারবেন না। ভোটের পরিবেশ তাঁরা নিশ্চয়ই পর্যবেক্ষণ করতে থাকবেন।
সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে ভোট চাওয়ার কারণে ইসির অনুরোধে জামালপুরের জেলা প্রশাসককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারেই বক্তব্য দিতে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সোমবার প্রেস ব্রিফিং ডেকেছিলেন। প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, কোনো জেলা প্রশাসকের আচরণ পক্ষপাতমূলক হওয়া কাম্য নয়। তবে নির্বাচনের সময় পুলিশ ও প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখা বা নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়েও সাংবাদিকেরা প্রশ্ন রেখেছিলেন। সেই প্রশ্নেও কোনো মন্তব্য করতে চাননি সিইসি।
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধের মধ্যে কীভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, সে সম্পর্কে ইসির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে না। তবে ইসি সূত্রে জানা গেছে, গতানুগতিক ধারাতেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু করতে নিজেদের চিহ্নিত করা চ্যালেঞ্জ বা বাধাগুলো উত্তরণে কার্যকর তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করা এবং ইসির প্রতি আস্থার সংকট দূর করার প্রশ্নেও বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই; বরং তাদের কিছু কাজে বিতর্ক বেড়েছে। ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে, এই প্রশ্নে চলছে নানা আলোচনা।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও জোট বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনে আছে। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধকে ইসি তাদের এখতিয়ারের বাইরে বলে উল্লেখ করছে। ইসি বলছে, তাদের সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং নভেম্বরে তফসিল ঘোষণা করার কথা বলছে ইসি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত বছরের সেপ্টেম্বরে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল ইসি। ইসি সূত্র জানায়, কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, নির্বাচন সামনে রেখে আইন সংস্কার, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দেওয়ার কাজ শেষ করেছে ইসি। স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন, ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা, ভোটকেন্দ্র স্থাপন ও নির্বাচনী প্রশিক্ষণের কাজও চলছে।
ইতিমধ্যে নির্বাচনী প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরু করা হয়েছে। এর পাশাপাশি তফসিল ঘোষণার আগেই জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্বাচনসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল কেনাকাটার কাজও অনেকটা শেষ পর্যায়ে।
গতানুগতিক কাজেও বিতর্ক
নির্বাচনের আগে রুটিন বা গতানুগতিক কাজগুলো করতে গিয়েও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিতর্কিত ও সমালোচিত হয়েছে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন। যেমন ইসির প্রস্তাবে নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরওপি) সংশোধন করা হয়েছে। সেখানে ভোট বন্ধে ইসির ক্ষমতা কমানো হয়েছে। যদিও কমিশন এটা মানতে নারাজ। তাদের দাবি, ভোট বন্ধে তাদের ক্ষমতা কিছু ক্ষেত্রে বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে দুটি ভুঁইফোড় দলকে নিবন্ধন দেয় ইসি। এ নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে ইসি।
বিতর্ক আর নির্বাচন কমিশন এখন সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিতর্কিত নির্বাচন হলে রাজনৈতিক সংকট আরও প্রকট হবে।বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন)
নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য যেসব সংস্থাকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে, এ ব্যাপারেও নানা আলোচনা চলছে। ইসি প্রথম দফায় ৬৬টি স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থাকে নিবন্ধন দিয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু সংস্থা নামসর্বস্ব, কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা জড়িত।
পর্যবেক্ষক সংস্থার সংখ্যা কম হওয়ায় আবারও আবেদন আহ্বান করা হয়েছে। অন্যদিকে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের কাজে প্রথমবারের মতো নীতিমালা করে প্রশাসন ও পুলিশকে অন্তর্ভুক্ত করে সমালোচিত হয় ইসি। তবে সমালোচনার মুখে তাদের কাজ থেমে থাকেনি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইসির এসব পদক্ষেপে তাদের প্রতি আস্থা আরও কমেছে।
আউয়াল কমিশনের পূর্বসূরি কে এম নূরুল হুদা কমিশনও একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ঘোষিত কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী এই রুটিন কাজগুলো করেছিল। তবে আউয়াল কমিশনের কর্মপরিকল্পনায় গতানুগতিক বা রুটিন কার্যক্রমের বাইরে গিয়ে আরও কিছু উদ্যোগের কথা বলা হয়েছিল। তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে ১৪টি বাধা চিহ্নিত করেছিল। সেই সঙ্গে এসব বাধা উত্তরণের ১৯টি উপায়ও উল্লেখ করেছিল।
অবশ্য নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের অনেকে বলছেন, কমিশন তাদের কর্মপরিকল্পনায় কিছু বিষয় এমনভাবে তুলে ধরেছে, যাতে মনে হতে পারে, বিএনপিসহ আন্দোলনে থাকা দলগুলোকে বাইরে রেখেই নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা করেছে তারা। যেমন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সংজ্ঞায় কমিশন বলেছে, নিবন্ধিত যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিতে ইচ্ছুক, তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ হলো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। নির্বাচনের প্রধান চ্যালেঞ্জ বা বাধা হিসেবে ইসি যে বিষয়টি চিহ্নিত করেছিল, তা হলো ‘নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা সৃষ্টি’।
অর্থাৎ নির্বাচনের বাইরে থাকা কোনো দলের প্রতি আস্থা সৃষ্টি করা তাদের লক্ষ্য নয়। কিন্তু ইসিতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হলো ৪৪টি। সেখানে ইসি শুধু নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে চায়। বাস্তবতা হলো, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর এই কমিশনের প্রতি আস্থা নেই। অন্যদিকে কমিশনও বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেওয়ার কথা ভাবছে না।
বাধা উত্তরণে কী করবে ইসি
সুষ্ঠু নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ বা বাধা উত্তরণের প্রথম উপায় হিসেবে ইসি যে বিষয় চিহ্নিত করেছিল, তা হলো বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়ে সংবিধান ও নির্বাচনী আইন অনুযায়ী যে সুপারিশগুলো এসেছে, তা বাস্তবায়ন করা। গত বছর পর্যায়ক্রমে দেশের শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট নাগরিক, নির্বাচন–বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে ইসি।
বিশিষ্টজনদের নিয়ে গত বুধবার একটি কর্মশালা করে ইসি। সেখানেও বিশিষ্টজনেরা দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার কথা প্রকাশ করেন। তবে কমিশন শুরু থেকেই বলে আসছে, তাদের সংবিধানের বাইরে যাওয়ার এখতিয়ার নেই।
অবশ্য বিএনপিসহ নয়টি রাজনৈতিক দল সংলাপ বর্জন করে। ইসি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে আসা প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে ১০টি পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করে। পর্যবেক্ষণের সারসংক্ষেপ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর আর তেমন কোনো তৎপরতা নেই। অন্যদিকে বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে সংলাপে আসা সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের বিষয়েও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।
সংলাপে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনকালীন সরকারে কোনো না কোনো ধরনের পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দিয়েছিল। ইসি বলেছিল, নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, তা পুরোপুরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। নির্বাচনের সময় কয়েকটি মন্ত্রণালয়কে ইসির অধীন ন্যস্ত করার বিষয়টিও সংবিধানের আলোকে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন।
নির্বাচনী পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, নির্বাচনকালীন সরকার বা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে আনার এখতিয়ার কমিশনের নেই। কিন্তু ইসি যদি মনে করে, এ ধরনের কোনো প্রস্তাব বাস্তবায়িত না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হবে না, তাহলে তারা তা সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে পারে।
নির্বাচন সামনে রেখে গত বুধবার বিশিষ্টজনদের নিয়ে একটি কর্মশালা করে ইসি। সেখানেও বিশিষ্টজনেরা দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার কথা প্রকাশ করেন। তবে কমিশন শুরু থেকেই বলে আসছে, তাদের সংবিধানের বাইরে যাওয়ার এখতিয়ার নেই।
রোববার এক অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেছেন, আগামী নভেম্বরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সব দলের অংশগ্রহণ তাঁদের ওপর নির্ভর করে না। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির আন্দোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি রাজনৈতিক বিষয়। এতে কিছু করার এখতিয়ার কমিশনের নেই। তবে তাঁরা একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আশা করেন।
নেই প্রশাসন নিরপেক্ষ করার রূপরেখা
সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে ইসির উল্লেখ করা আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো নির্বাচনের দায়িত্বে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা, বিশেষ করে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরেপক্ষভাবে দায়িত্ব পালন। কাজটি কমিশন কীভাবে করবে, তার কোনো রূপরেখা এখন পর্যন্ত নেই। অবশ্য সরকারকে আবারও নির্বাচিত করে ক্ষমতায় আনার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য দেওয়ায় জামালপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ইমরান আহমেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে চিঠি দেয় ইসি। বৃহস্পতিবার ওই ডিসিকে প্রত্যাহার করা হয়।
সুষ্ঠু ভোটের বাধা উত্তরণের উপায়গুলোর মধ্যে আছে সরকারের কোনো সংস্থা কর্তৃক হয়রানিমূলক মামলা না করা, প্রচারে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা, জাল ভোট ঠেকাতে প্রতিটি ভোটকক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা ইত্যাদি। এই কাজগুলো কীভাবে করা হবে, তা এখনো খোলাসা করেনি ইসি। অন্যদিকে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর পরিকল্পনা থেকেও সরে এসেছে তারা।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিতর্ক আর নির্বাচন কমিশন এখন সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিতর্কিত নির্বাচন হলে রাজনৈতিক সংকট আরও প্রকট হবে।’