পুলিশ–আ. লীগ আতঙ্কে নারায়ণগঞ্জ বিএনপি

নেতাদের বাড়িতে যাচ্ছে পুলিশ। এলাকায় গিয়ে খোঁজ করছেন আ.লীগের কর্মীরাও। অযথা কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না—দাবি পুলিশের।

  • যুবদলের কর্মী শাওন হত্যার প্রতিবাদে জেলায় বিক্ষোভ কর্মসূচি থাকলেও বিএনপির নেতারা মাঠে নামেননি।

  • দুই মামলায় গতকাল পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

  • মামলা ও রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে মুখ না খুলতে শাওনের পরিবারকে বিভিন্নভাবে চাপ দেওয়ার অভিযোগ।

দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সকালে শোভাযাত্রা বের করে নারায়ণগঞ্জ মহানগর ও জেলা বিএনপি। শহরের ২ নম্বর রেলগেট এলাকায় তাদের বাধা দেয় পুলিশপ্রথম আলো ফাইল ছবি

নারায়ণগঞ্জে পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষে গুলিতে যুবদলের কর্মী নিহতের ঘটনার পর থেকে বিএনপির অনেক নেতার বাড়িতে যাচ্ছে পুলিশ। ফলে গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়ি ছেড়েছেন বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা। এমনকি শাওন হত্যার প্রতিবাদে জেলায় জেলায় কেন্দ্রীয়ভাবে বিক্ষোভ কর্মসূচি থাকলেও গতকাল শনিবার মাঠে নামেননি নারায়ণগঞ্জের নেতারা।

গতকাল বিকেলে নারায়ণগঞ্জ বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নয়জন নেতার বাড়িতে যান প্রথম আলোর দুজন প্রতিবেদক। তাঁদের মধ্যে আটজনই ঘটনার পর থেকে বাড়িছাড়া বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতাকে কেবল তাঁর কার্যালয়ে পাওয়া গেছে।

বিএনপির নেতাদের অভিযোগ, পুলিশের পাশাপাশি বিএনপির নেতাদের খুঁজছেন আওয়ামী লীগের কর্মীরাও। বাড়ির সামনে মহড়ার পাশাপাশি হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

‘আমি কোনো দলের নেতা-কর্মীদের বাড়িতে হামলা ও হুমকি সমর্থন করি না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখা হবে।’
আবদুল হাই, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি

মামলার আসামি ছাড়া অযথা কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমীর খসরু মাহমুদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে যাঁদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুই মামলায় গতকাল পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুন

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কোনো দলের নেতা-কর্মীদের বাড়িতে হামলা ও হুমকি সমর্থন করি না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখা হবে।’

গত বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে একজনের মৃত্যু ছাড়াও পথচারী-নারীসহ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ২৬ জন। পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও লাঠিপেটায় আহত হয়েছেন পুলিশের সদস্যসহ অর্ধশতাধিক মানুষ। এ সময় ডিআইটি বাণিজ্যিক এলাকা ও ২ নম্বর রেলগেট এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

আরও পড়ুন

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সংঘর্ষের ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ বিএনপির শীর্ষ নেতারাসহ ৭১ জনের নামে মামলা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে আরও ৮০০ থেকে ৯০০ জনকে। যুবদলের কর্মী শাওন প্রধান নিহতের ঘটনায় করা মামলায় অজ্ঞাতনামা পাঁচ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে।

এই ঘটনায় তিনি চাচা হিসেবে যতটুকু দায়িত্ব পালন করার করেছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যাতে অবনতি না হয়, সেটি দেখেছেন। শাওনের পরিবারকে মামলা করতে বলেননি, আবার না করতেও বলেননি।
শওকত আলী, ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক

শহরের নগর খানপুর এলাকার বাসিন্দা মহানগর ছাত্রদলের সভাপতি শাহেদ আহম্মেদ। গতকাল বিকেলে বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। সংঘর্ষের ঘটনার আগের রাত থেকেই শাহেদ বাড়িতে থাকেন না বলে জানিয়েছেন তাঁর বাবা সামসুদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার আগের রাতে তাঁদের বাড়িতে একদল পুলিশ হানা দেয়। অনেক ডাকাডাকি করলেও তাঁরা দরজা খোলেননি। এর আগে আওয়ামী লীগের লোকজন তাঁর ছেলেকে খুঁজতে এসেছিলেন। ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়েছিল।

মুঠোফোনে শাহেদ আহম্মেদ বলেন, ‘আমাদের কর্মীকে হত্যার পর আমাদেরই মামলার আসামি করা—ইতিহাসে এটা বিরল ঘটনা। আমরা এখন বাড়িতে থাকতে পারি না।’

যুবদলের কর্মী নিহতের পর থেকে মহানগর যুবদলের সদস্যসচিব মনিরুল ইসলামও বাড়ি ছেড়েছেন। গতকাল বিকেলে শহরের তল্লা এলাকায় গিয়ে তাঁর বাড়ি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। বাড়ির দোতলার ভাড়াটে ব্যবসায়ী শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ঘটনার পর থেকে মনিরুল বাড়িতে থাকেন না। মুঠোফোনে মনিরুল ইসলাম বলেন, তিনিসহ তাঁদের নেতা-কর্মীরা বাড়িঘর ছেড়ে আত্মগোপনে আছেন।

শহরের দেওভোগ পাক্কা রোড এলাকার বাড়িতে গিয়ে মহানগর ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি রাফি উদ্দিনকে পাওয়া যায়নি। রাফির মা রাশিদা জামান জেলা মহিলা দলের সাবেক সভাপতি। তিনি বলেন, পুলিশ-আওয়ামী লীগের লোকজন তালিকা করছে, খোঁজখবর নিচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার পুলিশ বাড়ির আশপাশে ঘুরে গেছে বলে দাবি করেন তিনি।

মহানগর বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সাখাওয়াত হোসেনও ওই দিনের ঘটনার পর থেকে বাড়িছাড়া। তাঁকে খুঁজতে কয়েক দফা পুলিশ বাড়িতে গেছে বলে মুঠোফোনে প্রথম আলোর কাছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘পুলিশ গুলি করে আমাদের নেতা-কর্মীকেও মারছে, অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছে, আবার গণগ্রেপ্তার করছে।’

মহানগর যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাশিদুর রহমানের মাসদাইরের বাড়িতে গিয়ে প্রধান ফটক বাইরে থেকে তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। বাড়িতে থাকা রাশিদুলের ছোট ভাই বজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, ২০১৩ সালের পর থেকেই ভাই বাসায় থাকেন না। হয়তো জেলে থাকেন, না হয় পলাতক। মাঝেমধ্যে আসেন।’

মুঠোফোনে রাশিদুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ৩৩টি রাজনৈতিক মামলা। বৃহস্পতিবারের ঘটনায় করা মামলায় আমার নাম নেই। কিন্তু অজ্ঞাত আসামি হিসেবে যেকোনো সময় গ্রেপ্তার হতে পারি। এই আশঙ্কায় বাড়ি ছেড়েছি।’

একই দিন নগরের বঙ্গবন্ধু সড়কের উকিলপাড়া এলাকায় মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আবদুস সবুর খান, মাসদাইরের পাক্কার পুল এলাকায় ফতুল্লা থানা বিএনপির আহ্বায়ক জাহিদ হাসান, বন্দরের নবীগঞ্জ কবিলের মোড় এলাকায় মহানগর বিএনপির সহসভাপতি ও বন্দর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আতাউর রহমানের বাড়িতে গিয়ে তাঁদের পাওয়া যায়নি।

মুঠোফোনে জাহিদের স্ত্রী নাসরিন হাসান বলেন, যুবদলের কর্মী নিহত হওয়ার পর থেকেই তাঁর স্বামী পলাতক। স্বামীর পলাতক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘২০১৪-এর নির্বাচনের পর তাঁকে বাসায় পাওয়াটা ভাগ্যের বিষয়। আমি ও আমার বড় দুই ছেলে এটাতে অভ্যস্ত। কিন্তু ছোট্ট মেয়েটা (৭) বাবার আদর পায় না। বাবাকে না দেখলেই কাঁদে। ওরে বোঝাইতেও পারি না।’

নারায়ণগঞ্জ জেলা যুবদলের আহ্বায়ক গোলাম ফারুক ওরফে খোকন কয়েক মাস আগে থেকেই বাড়িতে থাকেন না। এর মধ্যে শুক্রবার বিকেলে তাঁর রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া এলাকার বাড়ির সামনে অন্তত পাঁচটি ককটেল হামলা হয়। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জে যুবদলের নেতৃত্বস্থানীয় ও মধ্যম পর্যায়ের কেউই এখন বাড়িতে থাকতে পারছেন না।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল কাউসারকে তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে পাওয়া যায়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ চলছে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে।

জেলা বিএনপির সদস্যসচিব মামুন মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, মামলার কারণে তিনিসহ বিএনপির নেতা-কর্মীরা আতঙ্কে আছেন। জেলা ও মহানগর বিএনপির কোনো নেতা-কর্মী বাড়িতে নেই। এ কারণে তাঁরা শাওন হত্যার প্রতিবাদে কর্মসূচি ডাকলেও পালন করতে মাঠে নামেননি।

চাপের মুখে শাওনের পরিবার

এদিকে গুলিতে শাওন প্রধান নিহতের পর থেকে চাপে আছে তাঁর পুরো পরিবার। মামলা ও শাওনের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ, প্রশাসনসহ নানাভাবে তাঁদের চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। চাপের কারণে তাঁরা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চান না।

শাওন নিহতের ঘটনায় করা মামলার বাদী হিসেবে বড় ভাই মিলন হোসেনের নাম রয়েছে। তবে তিনি মামলার বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে বৃহস্পতিবার অভিযোগ করেছিলেন। শাওনের আরেক বড় ভাই ফরহাদ হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করিনি, মামলা করিনি। আমার ভাইকে যারা হত্যা করেছে, তাদের বিচার চাই।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে চাননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাওনের কয়েকজন আত্মীয় বলেন, শাওনের চাচা শওকত আলী আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। শাওন যুবদল করায় শওকত আলী বিপাকে পড়ে যান। তাই তিনিসহ আওয়ামী লীগের লোকজন তাঁদের নানাভাবে চাপ দিচ্ছেন। এ ছাড়া পুলিশ তাঁদের নানাভাবে চাপ দিয়েছে। তাঁরা অনেক কথা বলতে চাইলেও বলতে পারছেন না।

শাওনের পরিবারের অভিযোগ প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিচুর রহমান বলেন, ‘শাওনের ভাই মিলনসহ তিনজন ওই দিন সন্ধ্যায় থানায় এসে মামলা দায়ের করেন। তাঁরা স্বাক্ষর করা এজাহার জমা দিয়ে মামলার রেকর্ড কপি রাতেই নিয়ে গেছেন। কোত্থেকে এজাহার লিখে এনেছেন, তা আমরা জানি না। মামলা করেও কেন অস্বীকার করছেন, তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন।’

ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, এই ঘটনায় তিনি চাচা হিসেবে যতটুকু দায়িত্ব পালন করার করেছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যাতে অবনতি না হয়, সেটি দেখেছেন। শাওনের পরিবারকে মামলা করতে বলেননি, আবার না করতেও বলেননি।

ভাগনে হত্যার বিচারের দাবি জানিয়ে শাওনের মামা মোক্তার হোসেন বলেন, ‘এটা গণতান্ত্রিক দেশ। যে যে দল-ই করুক না কেন, একজন মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে—এর বিচার হবে না, এটা হতে পারে না। আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও জড়িতদের বিচার চাই।’