জোটবদ্ধ নির্বাচনে প্রতীক নিয়ে বেকায়দায় বিএনপি

বিএনপির দলীয় পতাকাছবি: বিএনপির ফেসবুক থেকে নেওয়া

যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচন করার ক্ষেত্রে প্রতীকের বিধান নিয়ে কিছুটা বেকায়দায় পড়েছে বিএনপি। আরপিওর সংশোধনীর কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর ফলে জোট করলেও দলগুলোকে নিজস্ব প্রতীকে ভোট করতে হবে; যা জোটবদ্ধ ছোট দলগুলোর জয়ের সম্ভাবনাকে ঝুঁকিতে ফেলেছে বলে মনে করছে বিএনপি। এ নিয়ে দলটির মিত্র নিবন্ধিত ছোট দলগুলোর মধ্যেও উদ্বেগ কাজ করছে বলে জানা গেছে।

এ পরিস্থিতিতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনীতে আবার পরিবর্তন আনতে সরকারের ওপর চাপ তৈরির চিন্তা করছে বিএনপি। এ ক্ষেত্রে ছোট দলগুলোও যাতে মাঠে ভূমিকা রাখে, সে প্রত্যাশাও করে বিএনপি।

ইতিমধ্যে একাধিক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল প্রতীক-সংক্রান্ত আরপিওর ২০ (১) ধারার সংশোধনী বাতিল চেয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে বলে দলগুলোর সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের আসনগুলো এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি বিএনপি। এ নিয়ে শরিকদের সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বৈঠক করছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আগামী সপ্তাহ-দশ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

তবে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী ও শরিক দলগুলোর চাহিদামতো আসন সমঝোতার ক্ষেত্রে তাঁরা কিছুটা জটিলতায় পড়েছেন। কিন্তু তার চেয়েও বড় সমস্যা মনে করা হচ্ছে জোটগত ভোটেও নিজস্ব প্রতীকে ভোট করার বিধানটিকে।

আরপিওর ওই সংশোধনীতে ‘বহুদলীয় গণতান্ত্রিক চর্চা ব্যাহত হবে’ বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।
আরও পড়ুন

ছোট দলগুলোর জয় কঠিন হবে

বিএনপি মনে করছে, জোটগত নির্বাচন করলেও নিজস্ব প্রতীকে ভোট করে ছোট দলগুলোর নেতাদের জয় সহজ হবে না। এর ফলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সুফল পেয়ে যেতে পারে। তাই বিএনপি আরপিওর ওই সংশোধনী বাতিল চাইবে।

বিএনপির উচ্চপর্যায়ের নেতারা বলছেন, জোটবদ্ধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ছোট দলগুলো তাদের পছন্দমতো দলীয় অথবা জোটের বড় শরিক দলের প্রতীকে ভোট করার অধিকার চায়—যা আগে ছিল। সম্প্রতি সরকার আইন করে তাদের সে অধিকার ক্ষুণ্ন করেছে।

একই রকম অভিমত জানান বিএনপির সম্ভাব্য জোটের শরিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীও। তিনি গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি দল জোট করবে, এটা তার গণতান্ত্রিক অধিকার। তেমনি তার বিজয় নিশ্চিত করার জন্য তুলনামূলক বেশি প্রসিদ্ধ কোনো প্রতীকে নির্বাচন করাটাও তার গণতান্ত্রিক অধিকার। আরপিওর এই সংশোধনী সেই অধিকার খর্বের শামিল। আমরা আগের বিধানটাই বহাল চাই।’

বিএনপির নেতারা বলছেন, তাঁরা ছোট দলগুলোর পছন্দমতো প্রতীকে ভোট করার গণতান্ত্রিক অধিকারকে সমর্থন করেন এবং তার জন্য ছোট দলগুলো এ বিষয়ে যদি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাতে বিএনপির সমর্থন ও সহযোগিতা থাকবে।

আরও পড়ুন
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে, এমন বিধানের ফলে ভোটের হিসাব-নিকাশে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিএনপি। লাভবান হতে পারে জামায়াতসহ তার মিত্র দলগুলো। এর হিসাবটা হচ্ছে, ছোট দলগুলো বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আছে একসঙ্গে নির্বাচন করার জন্য এবং সংসদ সদস্য পদে জোটের প্রার্থী হওয়ার আশায়।

বিএনপি ও তাদের সমমনা ছোট দলগুলোর নেতারা মনে করেন, একটি বিশেষ দলকে ভোটে সুবিধা করে দিতে সরকার গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ২০ (১) ধারার সংশোধনী এনেছে।

যদিও আরপিওর সংশ্লিষ্ট ধারা পরিবর্তন করা না-করা নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে কিছুদিন বেশ উত্তপ্ত বিতর্ক হয়। বিএনপি জোটবদ্ধ ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করার বিধান চায়নি।

আগে জোটবদ্ধভাবে কোনো দল নির্বাচনে অংশ নিলে জোটের শরিক যেকোনো দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে পারত। যেমন ২০১৮ সালে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের অনেকে বিএনপির ‘ধানের শীর্ষ’ প্রতীকে নির্বাচন করেছিল। বিএনপি সেটা বহাল চেয়েছে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী চেয়েছে জোটগত নির্বাচন করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন। বিএনপি এই বিধান নিয়ে নির্বাচন কমিশন ও আইন মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে আপত্তি জানিয়েছিল। জামায়াতও তখন পাল্টা অবস্থান নিয়েছিল।

শেষ পর্যন্ত নিবন্ধিত একাধিক দল জোটভুক্ত হলেও ভোট করতে হবে নিজ নিজ দলের প্রতীকে—এমন বিধান যুক্ত করে আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এতে বিএনপির পাশাপাশি জোটভুক্ত হতে আগ্রহী কিছু ছোট দলের মধ্যে সরকারের এই সিদ্ধান্তে অস্বস্তি তৈরি হয়।

এই সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্রের পরিসর ছোট করা হয়েছে। এতে সংশোধনী গণতন্ত্রের সহযোগী হয়নি। আমরা চাই সংশোধনী পরিবর্তন হোক। এ বিষয়ে আমরা জোটের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। সেখানে আলোচনার পর করণীয় ঠিক হবে।’
ববি হাজ্জাজ, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের (এনডিএম) চেয়ারম্যান
আরও পড়ুন
ববি হাজ্জাজ এখন জোটের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন
ছবি: জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ফেসবুক পেজ

এ বিষয়ে জোটের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন বলে জানান বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর একটি ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্রের পরিসর ছোট করা হয়েছে। এতে সংশোধনী গণতন্ত্রের সহযোগী হয়নি। আমরা চাই সংশোধনী পরিবর্তন হোক। এ বিষয়ে আমরা জোটের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। সেখানে আলোচনার পর করণীয় ঠিক হবে।’

আরও পড়ুন

লাভবান হবে কে?

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, জোটে ভোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে, এমন বিধানের ফলে ভোটের হিসাব-নিকাশে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিএনপি। লাভবান হতে পারে জামায়াতসহ তার মিত্র দলগুলো। এর হিসাবটা হচ্ছে, ছোট দলগুলো বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আছে একসঙ্গে নির্বাচন করার জন্য এবং সংসদ সদস্য পদে জোটের প্রার্থী হওয়ার আশায়। সে ক্ষেত্রে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীককে ছোট দলগুলোর নেতারা জয়ের ক্ষেত্রে বড় ভরসা হিসেবে দেখেন। আরপিওর প্রতীক-সংশ্লিষ্ট ধারাটি সংশোধনের ফলে এতে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বিএনপির সমর্থন পেলেও ব্যক্তি জনপ্রিয়তা না থাকলে ছোট দলগুলোর নেতাদের নিজ দলীয় প্রতীকে জেতা কঠিন হয়ে পড়বে।

একটি দল কোন প্রতীকে নির্বাচন করবে, সেটি তার গণতান্ত্রিক অধিকার। দেখা গেছে, একটি দল ছোট কিন্তু ওই দলের নেতা জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি চায় এ ধরনের জাতীয় নেতৃবৃন্দ সবাইকে সংসদে নিতে, যাতে সংসদীয় গণতন্ত্র সমৃদ্ধ হয়।
সালাহউদ্দিন আহমদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য
আরও পড়ুন
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

আরপিওর ওই সংশোধনীতে ‘বহুদলীয় গণতান্ত্রিক চর্চা ব্যাহত হবে’ বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একটি দল কোন প্রতীকে নির্বাচন করবে, সেটি তার গণতান্ত্রিক অধিকার। দেখা গেছে, একটি দল ছোট কিন্তু ওই দলের নেতা জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি চায় এ ধরনের জাতীয় নেতৃবৃন্দ সবাইকে সংসদে নিতে, যাতে সংসদীয় গণতন্ত্র সমৃদ্ধ হয়। তা ছাড়া বর্তমানে যত সংস্কার, সেটি তো দেশের কল্যাণেই। সেখানে আরপিওর এই সংশোধনী গণতান্ত্রিক অধিকার ও চর্চার বিপক্ষে।

আরও পড়ুন

বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা শরিক বা মিত্র দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের প্রার্থিতার বিষয়টি নানাভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করছেন। বিগত আন্দোলনে শরিক দলগুলোর নেতাদের ভূমিকা, তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থান, ভবিষ্যৎ সরকার গঠনে তাঁদের প্রয়োজনীয়তা—এ বিষয়গুলো প্রার্থিতার ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিচ্ছেন। সে হিসেবে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল ও জোটের জন্য অন্তত ২৫টি আসন ছাড়ের কথা ভাবা হচ্ছে।

এর বাইরে রয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস—এই দল দুটির সঙ্গেও নির্বাচনী সমঝোতার সম্ভাবনা রয়েছে বলে বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো মনে করে।

বিএনপি জোটের বাইরে ইতিমধ্যে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ আটটি দল বিভিন্ন দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন করছে। যদিও এটি এখন পর্যন্ত নির্বাচনী জোট কি না, তা পরিষ্কার নয়।

জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে রয়েছে মাওলানা মামুনুল হক নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ ইসলামী সাতটি দল
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, জামায়াত যে নির্বাচনী সমঝোতা করতে চাইছে, সে আটটি দল পরস্পর আস্থাশীল। তাদের কাছে ‘দাঁড়িপাল্লা’ বা ‘হাতপাখা’ প্রতীক মুখ্য বিষয় নয়। সমঝোতা হলে সবাই যার যার প্রতীকে প্রার্থী হবেন এবং একে অপরের পক্ষে এককাট্টা হয়ে কাজ করবেন। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে দুশ্চিন্তা নেই। কিন্তু বিএনপির ভাবনা হচ্ছে ধানের শীর্ষ প্রতীকে নির্বাচন করতে না পারলে ভোটের আগেই আসন হারানোর আশঙ্কা তৈরি হবে। আবার জোটের প্রার্থী হিসেবে বিএনপি আসন ছাড় দিলেও দলের কেউ বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলে সেটাও মিত্রদের জয়কে কঠিন করে তুলতে পারে।

আরও পড়ুন