জামিন নিয়েও বাড়ি ফিরতে ভয়

গ্রেপ্তার
প্রতীকী ছবি

নোয়াখালীতে বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে ১১ দিনের ব্যবধানে ১৩টি মামলা হয়েছে। পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীদের করা এসব মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন দলটির নেতা–কর্মীরা। অনেকে উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নিয়েও এলাকায় ফিরতে পারছেন না। এক মামলায় জামিন পেলে আরেক মামলায় ধরা হচ্ছে।

এমনই একজন সদর উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জিয়াউর রহমান। আওয়ামী লীগের দায়ের করা একটি মামলায় গত বৃহস্পতিবার তিনি হাইকোর্ট থেকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পান। শনিবার রাতে এলাকায় আসার পর গতকাল দুপুরে নোয়াখালী সুপার মার্কেটের নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে যায়।

আরও পড়ুন

সুধারাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ারুল ইসলাম বলছেন, জিয়াউর একটি মামলায় জামিন নিয়েছেন। কিন্তু একই দিন অন্য একটি ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্তে তাঁর নাম উঠে এসেছে। তাই তাঁকে আটক করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি পুলিশি হেফাজতে ছিলেন।

বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেছেন, নেতা–কর্মীদের গণহারে মামলায় জড়িয়ে গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা হচ্ছে। পুলিশ বাড়ি বাড়ি হানা দিচ্ছে। এজাহারে নাম না থাকা নেতা-কর্মীরাও এলাকায় থাকতে পারছেন না। পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের স্থানীয় কিছু নেতা-কর্মীও মামলায় জড়ানোর হুমকি দিচ্ছেন।

গতকাল রোববার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সদর, বেগমগঞ্জ ও সেনবাগ উপজেলায় বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের আটজন নেতার বাড়িতে গিয়ে ও স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে সাতজনকেই বাড়িতে পাওয়া যায়নি। একজনকে বাড়িতে পাওয়া গেলেও তিনি রাতে থাকেন না বলে জানিয়েছেন। আটজনের সাতজনই আগাম জামিনে আছেন। বাকি একজনের নামে কোনো মামলা নেই।

জামিনে থাকার পরও পুলিশের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগের বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার মো. শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কেউ যদি জামিনে থাকেন, তাহলে তো তাঁকে গ্রেপ্তারের সুযোগ নেই। তবে অন্য কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থেকে থাকে, সেটি ভিন্ন বিষয়। তিনি এ বিষয়ে খোঁজ নেবেন।

ভোলায় গুলিতে দুই নেতা নিহত এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিএনপি কর্মসূচি ঘিরে নোয়াখালীতে গত ২৩ আগস্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে নোয়াখালীর বিভিন্ন থানায় ১৩টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সুধারামে (সদর) তিনটি, সোনাইমুড়ীতে চারটি এবং বেগমগঞ্জ, সেনবাগ ও চাটখিল থানায় দুটি করে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ১৩৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা সূত্রে জানা গেছে।

পুলিশ জানায়, মামলাগুলোর মধ্যে আটটির বাদী পুলিশ। বাকি পাঁচটি মামলার বাদী আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা–কর্মী। এসব মামলায় মোট ১ হাজার ২২০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি ২ হাজার ৬৭০ থেকে ৩ হাজার ২৫০ জন। আসামিদের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলা, দাঙ্গাহাঙ্গামা সৃষ্টি, সরকারি কাজে বাধা দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার আসামি হিসেবে কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা–কর্মীরা আছেন।

শহরের (সদর উপজেলা) স্টেডিয়াম পাড়ার বাসিন্দা জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন খান। গতকাল বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। বাড়ির লোকজনের কাছ থেকেও তাঁর বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে নুরুল আমিন বলেন, সাম্প্রতিক ঘটনায় তাঁকে দুটি মামলায় আসামি করা হয়েছে। দুই মামলাতেই তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছেন। কিন্তু গ্রেপ্তার ও হয়রানির ভয়ে এলাকায় যেতে পারছেন না।

জেলা বিএনপির সদস্য শাহ জাফর উল্যাহর শহরের নতুন বাসস্ট্যান্ড–সংলগ্ন বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। বাড়ির বাসিন্দা মো. সুজন বলেন, শহরে গন্ডগোলের পর থেকে তিনি বাড়িতে নেই। কোথায় আছেন তা জানা নেই। মুঠোফোনে শাহ জাফর উল্যাহ বলেন, দুই মামলায় তিনি জামিন নিয়েছেন। এরপরও পুলিশ বাড়িতে হানা দিয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশ তাঁকে ফোন করে জানতে চেয়েছে, তিনি কোথায় আছেন।

জেলা স্বেচ্ছাবেক দলের সভাপতি সাবের আহমদ শহরের গোপাই এলাকার বাসিন্দা। বাড়িতে খোঁজ করে তাঁকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে সাবের আহমদ বলেন, তিনি আগাম জামিন নিয়ে এলাকাতেই আছেন, তবে বাড়িতে থাকেন না। সাবের হোসেন বলেন, ‘আমরা তো নেতা, এজাহারে নাম আছে। কিন্তু যাঁদের নাম নেই, তাঁদের বাড়িতেও হানা দিচ্ছে পুলিশ।’

নোয়াখালী পৌর বিএনপির সভাপতি আবু নাছেরের বাড়িতে দুপুরে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, দিনে বাড়িতে এলেও সতর্কতার সঙ্গে থাকেন। রাতে বাড়িতে থাকেন না। এই নেতার অভিযোগ, শহরে বিএনপির শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ বাধা দিল, গুলি করল। আবার উল্টো মামলা দেওয়া হলো বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে।

সদর উপজেলা যুবদলের সদস্য কালাদরাফ গ্রামের বাসিন্দা মাহমুদুর রহমান অভিযোগ করেন, তিনি আগাম জামিন নিয়েছেন। কিন্তু গত শনিবারও পুলিশ তাঁর রব বাজারের ওষুধের দোকানে গিয়ে খোঁজ করেছে।

বিকেলে বেগমঞ্জ উপজেলার একলাশপুর গ্রামে গিয়ে উপজেলা বিএনপির সভাপতি কামাক্ষ্যা চন্দ্র দাশকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। পরে মুঠোফোনে তিনি বলেন, দুটি মামলার পর তিনিসহ অধিকাংশ নেতা–কর্মী এলাকাছাড়া। দু-চারজন থাকলেও রাতে বাড়িতে থাকতে পারেন না। কারণ, প্রতি রাতেই পুলিশ বাড়িতে হানা দেয়।

সেনবাগ উপজেলার নবীপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা নেই। এরপরও গত কয়েক দিনে একাধিকবার পুলিশ তাঁর বাড়িতে হানা দিয়েছে। তিনি আত্মগোপনে আছেন।

সেনবাগ উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব মোক্তার হোসেন ওরফে ইকবাল মাস্টার বলেন, তিনিসহ প্রায় ৫০০ জন নেতা-কর্মী দুটি মামলায় আগাম জামিন নিয়েছেন। এরপরও অনেকে এলাকায় আসতে চাইছেন না। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নানা হুমকির কারণে।

তবে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শিহাব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির কাউকে মামলায় জড়ানো কিংবা পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়ার অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই।

জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, গত ২২ আগস্ট সুবর্ণচরে বিএনপির সমাবেশে জনসমাগম হয়েছিল আশাতীত। এতে আওয়ামী লীগ নেতা এবং পুলিশ প্রশাসনের চোখ কপালে উঠে যায়। তাঁরা বিএনপির অন্যান্য উপজেলার কর্মসূচিকে বানচাল করার নীলনকশা আঁকে। যার অংশ হিসেবে বিএনপির বিক্ষোভে হামলা করে। তারা নিজেরা ঘটনা ঘটিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের গণহারে মামলায় জড়িয়ে গ্রেপ্তার ও হয়রানিতে মেতে উঠেছে।