নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ে এখনো তালা, খোলা শুধু ৮ জেলায়

তালাবদ্ধ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর নয়াপল্টনেছবি: প্রথম আলো

ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ৫৮ দিন ধরে তালা ঝুলছে। জেলা পর্যায়েও দলটির স্থায়ী ও অস্থায়ী কার্যালয়গুলো বন্ধ, নেতা-কর্মীদের আনাগোনা নেই। খোলা আছে শুধু আটটি জেলায়। 

সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা বিএনপির কার্যালয়গুলোতে তালা ঝুলতে শুরু করে গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে, যেদিন ঢাকায় তাদের মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। মহাসমাবেশের দিন পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে এক পুলিশ সদস্যসহ দুজন নিহত হন। পুলিশ এরপর থেকে সারা দেশে অভিযান চালিয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা শুরু করে। তখন একে একে বন্ধ হতে থাকে দলটির সাংগঠনিক কার্যালয়। সেই অবস্থা এখনো চলছে। 

আরও পড়ুন

দেশের ৬৪ জেলাসহ বিএনপির সাংগঠনিক জেলা মোট ৮২টি। বিভাগীয় শহরগুলোর মহানগর কার্যালয় যেমন আছে, তেমনি রয়েছে জেলা কার্যালয়। কোথাও কোথাও বড় জেলা সাংগঠনিকভাবে উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত।

চারটি জেলায় বিএনপির কোনো কার্যালয় নেই। বাকি ৬০ জেলার কোথাও কোথাও নেতার বাসা ও ব্যক্তিগত স্থাপনা কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। 

বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কে তালা দিয়েছে, তা অস্পষ্ট। পুলিশ বলেছে, তারা তালা দেয়নি। বিএনপি অবশ্য পুলিশের তালা দেওয়ার কথাই বলছে। এদিকে গত কয়েক দিনে একাধিকবার নয়াপল্টনে গিয়ে দেখা গেছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঘিরে পুলিশি পাহারা থাকে। 

প্রথম আলোর প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা গত শনিবার সরাসরি গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানান, স্থায়ী ও অস্থায়ী (নেতার বাসাসহ) মিলিয়ে ৫২টি জেলায় বিএনপির কার্যালয় কার্যত বন্ধ। কোনো কোনো জায়গায় কার্যালয় কখনোই খোলা হয় না। কোথাও কোথাও অফিস সহকারীরা তালা খোলেন, তবে নেতা-কর্মীরা যান না, দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় না। ১৩টি কার্যালয়ে নিয়মিত ও অনিয়মিতভাবে পুলিশের পাহারা থাকে। 

বিএনপির ৮০টি সাংগঠনিক জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ৬৫টিতেই কার্যালয় কার্যত বন্ধ। 

বিএনপির নেতারা বলছেন, দলের কেন্দ্রীয় নেতাসহ জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের সক্রিয় নেতা-কর্মীরা গ্রেপ্তার আতঙ্কে আত্মগোপনে থাকছেন। ফলে কার্যালয় খোলা রাখার সুযোগ নেই। 

যেমন চট্টগ্রাম নগর বিএনপির কার্যালয়টি শহরের কাজির দেউড়ির নাসিমন ভবনে। সেটি গত ২৮ অক্টোবর থেকে বন্ধ রয়েছে। মাঝে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের কর্মসূচি পালনের জন্য একবার খোলা হয়েছিল। তারপর থেকে আবার বন্ধ। 

চট্টগ্রাম নগর বিএনপির দপ্তরের দায়িত্ব থাকা নেতা ইদ্রিস আলী গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার আসামি না হলেও বিনা পরোয়ানায় পুলিশ বিএনপি নেতা-কর্মীদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। যার কারণে নেতা-কর্মীরা কৌশল অবলম্বন করে দলীয় কর্মসূচিগুলো পালন করে যাচ্ছেন। 

মামলা ছাড়া অহেতুক কাউকে পুলিশ হয়রানি করা হচ্ছে না বলে দাবি করেন চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) স্পিনা রানী প্রামাণিক। 

চারটি জেলায় বিএনপির কোনো কার্যালয় নেই। বাকি ৬০ জেলার কোথাও কোথাও নেতার বাসা ও ব্যক্তিগত স্থাপনা কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। 

কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা 

২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর ওই দিন রাতেই ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মূল ফটকে তালা দেওয়া হয়। সেই তালা এখনো খোলেনি। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিন বিএনপি নয়াপল্টন বিজয় শোভাযাত্রা কর্মসূচি পালন করলেও কার্যালয় খোলা হয়নি। 

মহাসমাবেশ পণ্ডের পরদিন গত ২৯ অক্টোবর পুলিশ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে কড়া পাহারা বসায়। সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট কার্যালয়টির সামনে ‘ডু-নট ক্রস-ক্রাইম সিন’ লেখা হলুদ ফিতা দিয়ে ঘিরে রাখে। দুই দিন পর দুই পাশে বসানো হয় কাঁটাতারের ব্যারিকেড। ১৪ নভেম্বর ব্যারিকেড সরানো হয়। 

বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কে তালা দিয়েছে, তা অস্পষ্ট। পুলিশ বলেছে, তারা তালা দেয়নি। বিএনপি অবশ্য পুলিশের তালা দেওয়ার কথাই বলছে। এদিকে গত কয়েক দিনে একাধিকবার নয়াপল্টনে গিয়ে দেখা গেছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঘিরে পুলিশি পাহারা থাকে। 

পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনির হোসেন মোল্লা গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির কার্যালয়ের সামনে কোনো পুলিশ থাকে না। তবে নিরাপত্তার জন্য আশপাশে থাকে। 

জেলা কার্যালয়ের চিত্র

পঞ্চগড়, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী, মেহেরপুর, ফেনী, কক্সবাজার ও রাঙামাটি—এই আট জেলায় বিএনপির কার্যালয় খোলা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দিনাজপুর জেলা বিএনপির কার্যালয়টি একজন অফিস সহকারী খোলেন এবং বন্ধ করেন। রাজশাহী জেলা বিএনপির কার্যালয় নিয়মিত খোলা হয়। সেখানে নেতা-কর্মীরা যান। 

কোনো কোনো জেলায় কেন্দ্রীয় কার্যালয় বন্ধ থাকায় কোনো নেতার বাসা অথবা নিজস্ব অফিসকে ব্যবহার করা হতো। নেতা-কর্মীরা সেখানে যেতেন। এখন তা–ও বন্ধ। 

যেমন কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় ভিক্টোরিয়া কলেজ সড়কের পাশে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ও মহানগর বিএনপির কার্যালয়। এক কক্ষের ওই কার্যালয় গত ২৯ অক্টোবর থেকে বন্ধ রয়েছে। বিকল্প হিসেবে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমিন উর রশিদ ইয়াছিনের ব্যক্তিগত কার্যালয় পরিস্থিতি বুঝে ব্যবহার করা হতো। গত শনিবার গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও তালা ঝুলছে। 

কুমিল্লা বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইয়াছিন সাহেবের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক কার্যালয়ও বন্ধ গ্রেপ্তার আতংকে।’ 

বিএনপির কার্যালয়ের সামনে কোনো পুলিশ থাকে না। তবে নিরাপত্তার জন্য আশপাশে থাকে। 
পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনির হোসেন মোল্লা

গ্রেপ্তার ও দণ্ড

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতার অনেকেই গত ২৯ অক্টোবর ও তারপরে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁরা এখন কারাগারে। 

পুলিশ ও আদালত সূত্রের খবর এবং প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ মাসে বিএনপির ১ হাজার ৪৯৭ নেতা-কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। 

বিএনপির দাবি, গত ২৮ অক্টোবরের ৪ থেকে ৫ দিন আগে থেকে গত রোববার পর্যন্ত তাদের ২৩ হাজারের মতো নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই সময়ে দলটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৬৭০টির বেশি মামলা দেওয়া হয়েছে। অবশ্য আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপির এত নেতা-কর্মী গ্রেপ্তারের দাবি নাকচ করেছেন। 

কার্যালয় বন্ধের বিষয়ে বান্দরবান জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক জসীম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ নেতা-কর্মী মামলার আসামি। গ্রেপ্তারের ভয়ে তাঁরা আত্মগোপনে রয়েছেন। কার্যালয়ে সভা করে, সংগঠিত হয়ে কোনো কর্মসূচি পালন করা সম্ভব হয় না।