অস্ত্রধারীদের ‘খুঁজছে’ পুলিশ

ছাত্রদলের যে নেতার বাড়িতে হামলা হয়েছিল, তাঁকেই আসামি করে মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও দুজনকে মারপিটের অভিযোগে মামলা।

  • অস্ত্র হাতে মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল হাসান ও দুর্জয় পাল

  • বিরোধী পক্ষও অস্ত্র নিয়ে মিছিলে ঢুকতে পারে: ছাত্রলীগ

রূপগঞ্জে ছাত্রদল নেতা মাসুদুর রহমানের বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়।
প্রথম আলো ফাইল ছবি

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বাড়িতে হামলা–লুটপাট অব্যাহত আছে। গত রোববার রাতেও পাঁচ নেতার বাড়িতে হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এদিকে রূপগঞ্জের ভুলতা এলাকায় গত রোববার দুপুরে চাইনিজ কুড়াল, চাপাতি, রড ও লাঠিসোঁটা হাতে মিছিলে অংশ নেওয়া তরুণেরা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

ওই মহড়ার ছবি গতকাল প্রথম আলোয় ছাপা হওয়ার পর জেলায় ব্যাপক সমালোচনা হয়। ছবি ধরে অনুসন্ধান করে মিছিলে অংশ নেওয়া তরুণদের পরিচয় পাওয়া গেছে। অস্ত্রধারীদের ‘সন্ধান’ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে জেলা পুলিশ।

‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পুলিশ কী করছে, তা দেখভাল করা আমাদের কাজ। কিন্তু কোনো জায়গায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে প্রথমে রেসপন্স করবে (সাড়া দেবে) পুলিশ। তারপর তারা কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সেটা আমরা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আলোচনা করি।’
ফয়সাল হক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)

রূপগঞ্জ উপজেলা নারায়ণগঞ্জ–১ সংসদীয় আসনের মধ্যে পড়েছে। এ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী বর্তমানে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও। গতকাল রাতে বারবার যোগাযোগ করেও ফোন না ধরায় তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলা সম্ভব হয়নি। মোবাইলে খুদে বার্তা পাঠালেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন

রাজধানীতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে গত শনিবার রাত ৯টায় ভুলতা এলাকায় অনুসারীদের নিয়ে মশালমিছিল করেন জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি মাসুদুর রহমান। এরপর রাতেই তাঁর বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। একই সময় যুবদল ও ছাত্রদলের আরও পাঁচ নেতা-কর্মীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা-লুটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরপর গত রোববার দিনভর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের মহড়া দিতে দেখা যায়।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পুলিশ কী করছে, তা দেখভাল করা আমাদের কাজ। কিন্তু কোনো জায়গায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে প্রথমে রেসপন্স করবে (সাড়া দেবে) পুলিশ। তারপর তারা কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সেটা আমরা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আলোচনা করি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফয়সাল হক

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভুলতায় অস্ত্র হাতে মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন নাজমুল হাসান ওরফে সবুজ ও দুর্জয় পাল। নাজমুল উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি। দুর্জয় কোনো পদে না থাকলেও ছাত্রলীগ নেতা হিসেবেই পরিচিত। তিনি উপজেলা আওয়ামী মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শীলা রানী পালের ছেলে। মিছিলে অংশ নেওয়াদের বেশির ভাগ এই দুই নেতার অনুসারী হিসেবে পরিচিত। মিছিলের সামনের দিকের তরুণদের পরিচয় পাওয়া গেলেও শেষের দিকে থাকা কিশোরদের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেননি স্থানীয়রা।

স্থানীয় ও দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নাজমুল হাসানের ছোট ভাই ভুলতা ইউনিয়নের পাচাইখা এলাকার মো. মানিক, একই এলাকার সজীব আহমেদ ওরফে সুলতান, গোলাকান্দাইল ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি পদপ্রত্যাশী সাইফুল ইসলাম, ভুলতা টেকপাড়া এলাকার রাজু, একই এলাকার মো. ফাহিম, শোনাব এলাকার মো. মোমেন, মৈরাবো এলাকার মো. রুবেল, টেকপাড়া এলাকার মো. মাসুদ ও একই এলাকার বিজয় মিছিলে অংশ নেন। তাঁরা সবাই নাজমুল হাসানের অনুসারী।

আরও পড়ুন

এ ছাড়া মর্তুজাবাদ এলাকার মো. আলিফ রামদা হাতে, একই এলাকার ফাহিম চাইনিজ কুড়াল হাতে, বাজনাবাড়ি এলাকার রাশিদুল রামদা হাতে, আমলাব এলাকার মো. ইয়াসিন, রামদা হাতে ও নাহাটি এলাকার মো. আবিরকে মিছিলে দেখা গেছে। স্থানীয় রাজনীতিতে তাঁরা দুর্জয়ের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

সশস্ত্র মহড়ার বিষয়টি জানতে চাইলে ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল হাসান বলেন, ‘সমগ্র রূপগঞ্জ থেইকা পজিটিভ-নেগেটিভ অনেকেই মিছিলে আসে। এইখানে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগসহ সব সংগঠনের মিছিল ছিল। কারা অস্ত্র হাতে এসেছিল জানি না।’ ছাত্রলীগকে বিতর্কিত করার জন্য বিরোধী পক্ষের লোকজনও অস্ত্র নিয়ে মিছিলে ঢুকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

দুর্জয় পালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রশ্ন শুনেই ফোন কেটে দেন। এরপর একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

এ ছাড়া মর্তুজাবাদ এলাকার মো. আলিফ রামদা হাতে, একই এলাকার ফাহিম চাইনিজ কুড়াল হাতে, বাজনাবাড়ি এলাকার রাশিদুল রামদা হাতে, আমলাব এলাকার মো. ইয়াসিন, রামদা হাতে ও নাহাটি এলাকার মো. আবিরকে মিছিলে দেখা গেছে। স্থানীয় রাজনীতিতে তাঁরা দুর্জয়ের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

বিষয়টি নিয়ে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল সাংবাদিকদের বলেন, যাঁরা রামদা, কুড়াল নিয়ে মহড়া চালিয়েছেন, তাঁদের সন্ধান করা হচ্ছে। ঘটনার তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নিতে থানা-পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আবার নেতাদের বাড়িঘরে হামলা

ভুলতার পর রূপগঞ্জের চনপাড়া পুনর্বাসনকেন্দ্র এলাকায় বিএনপি ও যুবদলের পাঁচ নেতার বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত রোববার রাত সাড়ে ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত এসব হামলার ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো বলছে, ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়ে বাড়িতে হামলা চালানো হয়। এ সময় হামলাকারীরা ‘বিএনপির দালালেরা, হুঁশিয়ার সাবধান’ বলে স্লোগান দেয়। বাড়ির লোকজনকে মারধর ও জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। হামলাকারীদের অধিকাংশই কিশোর।

রোববার রাতে কায়েতপাড়া ইউনিয়নের চনপাড়া সাংগঠনিক ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি হারুন মিয়াজি, যুগ্ম সম্পাদক ইউসুফ হাওলাদার, ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সহসভাপতি মো. কামাল, ৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য হযরত আলী ও ৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি মো. মাসুমের বাড়িতে হামলা হয় বলে অভিযোগ।

৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি মো. মাসুম প্রথম আলোকে বলেন, অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়ে একদল লোক তাঁর বাড়িতে হামলা চালান। বাড়ির প্রধান ফটকের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পরিবারের লোকজনকে মারধর করেন। ঘরে থাকা আসবাব ভাঙচুর করে টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে যান।

প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের ভাষ্য অনুযায়ী, হামলাকারীরা রূপগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের নেতা ও কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বজলুর রহমানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

এ বিষয়ে বজলুর রহমানের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেও কথা বলেননি। পরে একাধিকবার ফোন করলে তিনি কেটে দেন। খুদে বার্তা পাঠিয়েও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ ছাড়া গতকাল বিকেলে ভুলতা ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি শাকিল হাসানের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আবার হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন শাকিল। শনিবার রাতেও তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লুট হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘হামলাকারীরা বাড়ির গেইটে এসে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে গেছে। তারা বলছে, প্রথম আলোর কাছে আমিই তথ্য দিছি, আমিই ভিডিও দিছি।’

এদিকে শনিবার রাতে ভুলতা এলাকায় জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি মাসুদুর রহমানের বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। তবে মশালমিছিলের ঘটনায় মাসুদুর রহমানসহ ১০ জনের নামে মামলা হয়েছে। ভুলতা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক হানিফ মিয়া বাদী হয়ে গতকাল রূপগঞ্জ থানায় করা মামলায় অজ্ঞাত আরও ১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

এজাহারে বলা হয়েছে, শনিবার রাতে আসামিরা লাঠিসোঁটা, ককটেল, পিস্তল, রামদা ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে মশালমিছিল বের করে টায়ারে অগ্নিসংযোগ করে।

এ সময় রুহুল আমিন ও সানি নামের দুজনকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করা হয়। পরে ককটেল বিস্ফোরণ করে তিনটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে তাঁরা পালিয়ে যান।

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা বলেন, হামলার শিকার বিএনপি নেতা–কর্মীরা থানায় এসে অভিযোগ দেন না। তাঁরা যে ঘটনা বলেন, ঘটনাস্থলে গেলে তার উল্টো পাওয়া যায়।

রূপগঞ্জের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফয়সাল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পুলিশ কী করছে, তা দেখভাল করা আমাদের কাজ। কিন্তু কোনো জায়গায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে প্রথমে রেসপন্স করবে (সাড়া দেবে) পুলিশ। তারপর তারা কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সেটা আমরা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আলোচনা করি।’

উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান বলেন, এটা ধারাবাহিক হামলার অংশ। ২৯ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত রূপগঞ্জে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের অন্তত ৪২ জন নেতা-কর্মীর বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।