ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের জয়ের কারণ দীর্ঘ প্রস্তুতি
ভিপি ও জিএস পদে কোন দুজন প্রার্থী হচ্ছেন, সেটি ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে কোনো ছাত্রসংগঠনই ঠিক করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ইসলামী ছাত্রশিবির।
ভোটের ছয় মাস আগে থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় ডাকসু নির্বাচন হলে শিবিরের প্যানেল থেকে ভিপি পদে আবু সাদিক কায়েম ও জিএস পদে এস এম ফরহাদ নির্বাচন করবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন ঘিরে দীর্ঘ প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা ছিল শিবিরের। নির্বাচনের প্যানেল তৈরি ও প্রচারের ক্ষেত্রে সেই পরিকল্পনার ছাপ দেখা গেছে।
ইসলামপন্থী ছাত্রসংগঠন হলেও শিবির তাদের প্যানেল ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ করার চেষ্টা করেছে। নিজেদের প্যানেলে চারজন ছাত্রী ও চাকমা সম্প্রদায়ের একজন শিক্ষার্থীকে রেখেছে তারা।
শিবিরের প্যানেলের বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে হিজাব পরা এবং হিজাব না পরা—দুই ধরনের প্রার্থীই দেখা যেত। এর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত জীবনে ‘অস্বস্তি’ তৈরি হয়, এমন অনেক কাজ থেকে নিজেদের দূরে রাখার চেষ্টা করে গেছেন সংগঠনটির নেতারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন ঘিরে দীর্ঘ প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা ছিল শিবিরের। নির্বাচনের প্যানেল তৈরি ও প্রচারের ক্ষেত্রে সেই পরিকল্পনার ছাপ দেখা গেছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে যখন শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেন, তখনো হলে হলে কৌশলগত অবস্থান ধরে রাখে শিবির। রাজনৈতিক পরিচয় সামনে না এনে হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নানা কার্যক্রমে যুক্ত থেকেছে তারা। হলে ও ক্যাম্পাসে বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজেও সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা যুক্ত ছিলেন। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিবিরের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের যুক্ততা তৈরি হয়, যা নির্বাচনী প্রস্তুতির ক্ষেত্রও তৈরি করে দেয়। ছাত্রদলসহ অন্য সংগঠনগুলোর সে অর্থে তেমন কোনো প্রস্তুতি ছিল না।
শিবিরের সাংগঠনিক কাঠামোও নির্বাচনে অন্যদের চেয়ে তাদের এগিয়ে রেখেছিল। সাদিক কায়েমকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের নেপথ্যের নায়ক হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা নানাভাবে করে গেছেন সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা। সর্বশেষ গত ২৪ জুলাই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরায় ‘জুলাইয়ের ৩৬ দিন’ শীর্ষক তথ্যচিত্রে জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রসংগঠক হিসেবে সাদিককে আলাদাভাবে উপস্থাপন করা হয়।
হুট করে কিছু হয়নি। এটা শুধু ২০ দিনের নির্বাচনী প্রচারের ফল নয়, এটা একটা লিগ্যাসি বা ধারাবাহিকতা। সবার সঙ্গে যুক্ততা, সক্ষমতা, ব্যক্তিত্ব, সবার কাছে যাওয়া, কথা শোনা—সব মিলিয়েই শিক্ষার্থীরা আমাকে বেছে নিয়েছেন।আবু সাদিক কায়েম, ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের প্যানেলের নবনির্বাচিত ভিপি
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ক্যাম্পাসে শিবিরের প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ না থাকলেও গোপনে তারা কার্যক্রম চালিয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে আসেন শিবিরের নেতারা। তখন জানা যায় ক্যাম্পাসে শিবিরের সাংগঠনিক কাঠামো ও কমিটির কার্যক্রম (অপ্রকাশ্য) ছিল।
ক্যাম্পাসে আলোচনা আছে, গত এক বছরে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন শিবিরের বিরুদ্ধে ‘ট্যাগিংয়ের’ পুরোনো রাজনীতিই করেছে। এটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকে পছন্দ করেননি।
এ ছাড়া এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পেশিশক্তির রাজনীতি বন্ধ আছে, গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতিও নেই। কোনো রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের কর্মসূচিতে যাওয়া এখন আর কারও জন্য বাধ্যতামূলক নয়। হল ও ক্যাম্পাসকে ভবিষ্যতেও এ রকম রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রচার চালিয়েছে শিবির। এই প্রচারও নির্বাচনে তাদের সহায়তা করেছে।
ইসলামপন্থী ছাত্রসংগঠন হলেও শিবির তাদের প্যানেল ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ করার চেষ্টা করেছে। নিজেদের প্যানেলে চারজন ছাত্রী ও চাকমা সম্প্রদায়ের একজন শিক্ষার্থীকে রেখেছে তারা।
ডাকসুতে শিবিরের বিশাল জয়
গত মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে বিশাল জয় পেয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির। নির্বাচনে তাদের প্যানেলের নাম ছিল ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’। এই প্যানেলের প্রার্থীরা ভিপি, জিএস, এজিএসসহ ২৮টি পদের মধ্যে ২৩টিতেই জিতেছেন।
ডাকসুর ভিপি (সহসভাপতি) নির্বাচিত হয়েছেন শিবিরের নেতা মো. আবু সাদিক কায়েম। জিএস (সাধারণ সম্পাদক) নির্বাচিত হয়েছেন এস এম ফরহাদ। আর এজিএস (সহসাধারণ সম্পাদক) হয়েছেন মুহা. মহিউদ্দীন খান।
শীর্ষ তিন পদের পাশাপাশি ডাকসুর ১২টি সম্পাদকীয় পদের ৯টিতেই জিতেছেন শিবির-সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা। এ ছাড়া ডাকসুর ১৩টি সদস্য পদের মধ্যে শিবিরের প্রার্থীরা ১১টিতেই জয়ী হয়েছেন।
বিশাল এই জয়ের বিষয়ে শিবিরের নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের খোঁজ রাখা, সংকটে পাশে থেকে সহযোগিতা করাসহ বিভিন্ন কাজে গত এক বছর যুক্ত ছিলেন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। কিন্তু এ নিয়ে তাঁরা প্রচার চালাতেন না, যা শিক্ষার্থীরা পছন্দ করেছেন।
অন্যদিকে নির্বাচনে বিভিন্ন প্যানেলের ভোট কয়েক ভাগে ভাগ হলেও শিবিরের ভোট সেভাবে ভাগ হয়নি। এই বিষয়গুলো তাঁদের নির্বাচনে এগিয়ে রেখেছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে যখন শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেন, তখনো হলে হলে কৌশলগত অবস্থান ধরে রাখে শিবির। রাজনৈতিক পরিচয় সামনে না এনে হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নানা কার্যক্রমে যুক্ত থেকেছে তারা।
‘হুট করে কিছু হয়নি’
ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করার পর গতকাল বুধবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন নবনির্বাচিত ভিপি সাদিক কায়েম ও জিএস এস এম ফরহাদ। সেখানে তাঁরা সব মত ও আদর্শের সঙ্গে মিলে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করেন।
সাদিক কায়েম ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে এখন তিনি এমফিল করছেন। নিজের ও শিবিরের প্যানেলের জয়ের ব্যাপারে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘হুট করে কিছু হয়নি। এটা শুধু ২০ দিনের নির্বাচনী প্রচারের ফল নয়, এটা একটা লিগ্যাসি বা ধারাবাহিকতা। সবার সঙ্গে যুক্ততা, সক্ষমতা, ব্যক্তিত্ব, সবার কাছে যাওয়া, কথা শোনা—সব মিলিয়েই শিক্ষার্থীরা আমাকে বেছে নিয়েছেন।’
সাদিক বলেন, তাঁরা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ধারণায় বিশ্বাস করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের আমলে তাঁদের এই বক্তব্যগুলো সামনে আনতে দেওয়া হয়নি। তাঁরা সবাইকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করবেন।