বাংলাদেশ আবারও আরেক ক্রান্তিলগ্নে

গোটা দেশে যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়ে আছে, সেগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষণ এবং সমাধান আজ জরুরি। সেটি একটি নিরপেক্ষ এবং দক্ষ সরকারের হাতে সম্পন্ন হতে পারে, তবে তার কাঠামো কী হবে, সেটি ভাবার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ। সম্প্রতি নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেফাইল ছবি

বাংলাদেশ আবার এক ক্রান্তিলগ্নে এসে পৌঁছেছে। প্রায় ১৪ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার দেশ শাসন করছে। তাদের সর্বশেষ শাসনকালের মেয়াদ ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে জানুয়ারি মাসে। আসন্ন ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে নানা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বে সরকারবিরোধী আন্দোলন দেশের বিভাগীয় শহর এবং রাজধানী ঢাকায় বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। আপাতদৃষ্টে মানুষ তাদের আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে। আন্দোলনের মূল দাবি বর্তমান সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন। এই দাবির সঙ্গে আরও যোগ হয়েছে ব্যাংকিং খাতে অচলাবস্থা, লাগামহীন দুর্নীতি, নির্যাতনমূলক আইনের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

ইতিমধ্যে রাজপথে রক্ত ঝরেছে, বিরোধী পক্ষের অনেক নেতা আটক হয়ে এখন জেলে অবস্থান করছেন। কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও অস্থিরতা বিরাজমান। একদিকে চীন, রাশিয়া, ভারত এবং হয়তোবা সৌদি আরব বর্তমান সরকারের পক্ষে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাপান বর্তমান সরকারকে চাপের মধ্যে রাখতে চায়। সবকিছু নির্দেশ করছে যে আগামী দিনগুলো হবে সংঘাতময়।

আরও পড়ুন

জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি মূল সমস্যা নয়

আওয়ামী লীগ সরকারের দাবি, দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট তাদের সৃষ্ট নয়, নানা আন্তর্জাতিক ঘটনা তার জন্য দায়ী, যার মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রধান। এ যুক্তি অবশ্য অধিকাংশ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ভোগ্যপণ্যের মূল্য কেবল আমাদের দেশে বৃদ্ধি পায়নি। সারা বিশ্ব মূল্যস্ফীতির কারণে একই সমস্যায় ভুগছে। তবে অন্য দেশে মানুষের ক্ষোভ, প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ তেমন নেই। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে ফিরে দেখি, এখানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। কিছুদিন আগে এখানে নির্বাচন হয়েছিল এবং অস্ট্রেলিয়ার লেবার পার্টি ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। বিরোধী দল হিসেবে লিবারেল পার্টি মূল্যবৃদ্ধিকে প্রধান ইস্যু করে আন্দোলন গড়তে চেয়েছিল। কিন্তু শত প্রচারণা সত্ত্বেও জরিপে দেখা গেল, সরকারের জনপ্রিয়তা কমেনি বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। তার কারণ, বাংলাদেশের মতো এখানে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নৈরাজ্য এবং অবাধ লুটপাট নেই। প্রতিটি সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আইন মেনে চলে। এখানে স্বজনপ্রীতির স্থান নেই। এখানে মানুষ গুম হয় না। এখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা আছে, আছে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর আস্থা।

জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশের মূল সমস্যা নয়, সমস্যা সরকারের ওপর আস্থার অভাব। বাংলাদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে মানুষ দিব্যি বুক ফুলিয়ে বেড়াতে পারে। মামুলি কোনো সমালোচনায় মানুষকে জেলে যেতে হয় অথচ লুটপাটের রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে যারা দেশের মূল নীতিমালাকে প্রতিনিয়ত লঙ্ঘন করছে, তারা বিলাসবহুল জীবন যাপন করে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রশাসনের ভারও তাদের ওপর ন্যস্ত হয়।

আরও পড়ুন

আমাদের দেশে রাজনীতির ক্ষেত্রে আস্থাহীনতার সংকট নতুন কিছু নয়। আমাদের ইতিহাসে এটি একটি প্রবণতা যে ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই রাজনীতিবিদেরা জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেন। সে কারণে বিগত ৫০ বছর ধরে মাঝেমধ্যে বিরতি দিয়ে সংকটের ধারা চলে এসেছে, দেশ চলছে এক ক্রান্তিলগ্ন থেকে আরেক ক্রান্তিলগ্নে। সংঘাতময় ইতিহাসের সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে। তারপর সামরিক অভ্যুত্থানে জেনারেল জিয়া নিহত হলেন। দুই রাষ্ট্রপ্রধান, চার জাতীয় নেতা, বহু সামরিক কর্মকর্তা এবং সেনাসদস্যকে সামরিক অভ্যুত্থানে হয় ফাঁসিতে অথবা প্রতিশোধ দেওয়া-নেওয়ায় প্রাণ বিসর্জন দিতে হলো। এর সঙ্গে যোগ হলো সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ, বিতর্কিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংস আন্দোলন এবং অসাংবিধানিক পথে ক্ষমতা রদবদলের সংস্কৃতি। ফলে যে বিষাক্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তা শিলায়িত হয়ে আজও চলছে এবং তার শেষ কোথায়, কেউ জানে না।

সহনীয় তর্কবিতর্কের পরিবেশ কোথায়

যেকোনো দেশে শাসক এবং জনগণের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকাটা স্বাভাবিক, কিন্তু তার প্রকাশ ঘটা উচিত সহনীয় তর্কবিতর্কের মাধ্যমে। ইউরোপে এই তর্কবিতর্ক মার্জিত পরিবেশে হয়েছে। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও আমাদের উদাহরণ হতে পারে। একদিকে সরকার ও তার মন্ত্রিসভা, অন্যদিকে দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী এবং মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি। দেশভাবনার ছক নিয়ে তারা সরকারের কাছে দেনদরবার করেছে; আদান–প্রদান শেষ হয়েছে কখনো সমঝোতায়, কখনো নিজের দাবিকে পরিবর্তন করে, কখনোবা রাজপথে আন্দোলনে নেমে। সরকারের মন্ত্রিপরিষদও তাদের অবস্থানে অনড় থাকেনি। কখনো তাদের সম্পর্ক শেষ হয়েছে তীব্র মনোমালিন্যে, মাঝেমধ্যে শাসকগোষ্ঠী নিপীড়নের আশ্রয় নিয়েছে, কিন্তু দুই পক্ষের মধ্যে স্থায়ী সচলতার পথে বিশেষ কোনো বিঘ্ন ঘটেনি, যদিও সেই সচলতা দুই পক্ষকে কখনো কাছে এনেছে, কখনো তাদের মধ্যকার সম্পর্কে সৃষ্টি হয়েছে দূরত্ব। ওই সম্পর্ক ছিল সমুদ্রের মতো গতিশীল এবং সচল; ঠিক মহাসমুদ্রের ঢেউ যেভাবে কূলকে আঘাত করে আবার গভীর জলরাশিতে আত্মগোপন করে।

বাংলাদেশে জনগণ এবং শাসকশ্রেণির মধ্যে আদান–প্রদানের স্থায়ী বা অস্থায়ী কোনো কাঠামো গড়ে ওঠেনি। শাসকশ্রেণির চারপাশে ক্ষুদ্র ধনিকশ্রেণি প্রতিরোধের দেয়াল গেঁথে বৃহত্তর সমাজ থেকে নিজেকে অবমুক্ত রাখার অন্তহীন প্রয়াস চালিয়েছে। তা থেকে জন্ম নিয়েছে দুই বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব, দুই ভিন্ন জগৎ—একদিকে শাসক, অন্যদিকে জনগণ। শাসক ক্ষমতায় এসেছে, বিদায় নিয়েছে, কিন্তু ওই ভেদরেখা থেকে গেছে অনতিক্রান্ত। সম্ভবত এ কারণেই সুশীল সমাজের সাবলীল বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়ে এমন এক সমাজকাঠামোর জন্ম হয়েছে, যেখানে স্থান করে নিয়েছে ধনিকশ্রেণি এবং সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র নিয়ে গড়ে ওঠা ক্ষমতার এক বলয়। এ ধরনের কাঠামো গড়ে ওঠে যখন সরকার তার বৈধতা হারায়। বর্তমান সরকার ২০০৮ সালে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলেও ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাকে আমলাতন্ত্র বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। এই দুই সংগঠন চলে উপরি কর্তৃপক্ষের আদেশবলে। ফলে তাদের চরিত্রে রয়েছে কর্তৃত্ববাদী উপাদান। দেশ শাসনে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যদি, যে কারণেই হোক, তাঁদের ওপর নির্ভরশীল বা জিম্মি হয়ে পড়েন, তাহলে তাঁদের চরিত্রেও কর্তৃত্ববাদ স্থান করে নিতে বাধ্য। বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোয় কর্তৃত্ববাদ, অসহিষ্ণুতা এবং দর্পিত মনোভাবের প্রধান উৎস সম্ভবত এখানে।

রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি

এই সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হচ্ছে রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনা। দ্রুত এই আস্থার জায়গাটা সৃষ্টি করা কঠিন। অর্থনীতি থেকে শুরু করে জীবনের সর্বক্ষেত্রে যে জঞ্জাল সৃষ্টি হয়ে আছে, তা পরিষ্কার করা হারকুলিয়ান প্রচেষ্টার মতো শোনাতে পারে। তবে বর্তমান সরকারের পক্ষে সেই দায়িত্ব কাঁধে নেওয়া এবং জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা বোধ হয় সম্ভব নয়। গণমানুষের আস্থা অনেকটা হারিয়ে তারা জানে, নিরপেক্ষ নির্বাচনে হয়তো তাদের ভরাডুবি হবে। সে কারণে নিরপেক্ষ নির্বাচনে তারা ভীত। বিরোধী দল ও তার অঙ্গসংগঠন নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় এবং রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব হাতে নিতে চায়। কিন্তু বিএনপির ওপর আস্থা রাখার কোনো কারণ দেখা যাচ্ছে না। তাদেরও অতীত দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির ইতিহাস অবিদিত নয়। বিএনপি বিগত দিনে দেশ শাসনের দায়িত্ব পেয়েছিল। তারাও দেশকে অনেকটা ধ্বংসের পথে নিয়ে গিয়েছিল। এমন গুণগত কোনো পরিবর্তন ওই দলে আজও ঘটতে দেখা যায়নি যে নতুন করে মানুষ তাদের ওপর আস্থা রাখবে। ফলে তাদের হাতে দেশ মেরামতের দাবিও কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, তা ভবিষ্যতে বলা যাবে।

বস্তুত উভয় দলের ওপর দেশের মানুষের আস্থাহীনতা আজকের দিনের বাস্তবতা। সে কারণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করাও কতটা যৌক্তিক, সেটা ভাবার বিষয়। নিরপেক্ষ নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ হলেও আজকের দিনের প্রধান প্রশ্ন দেশের অর্থনীতির নানা বিভাগসহ আমলাতন্ত্র, দুর্নীতি, বিদেশে অর্থ পাচার ইত্যাদি সংকটের বিহিত করা, যা রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ক্যানসারের মতো বাসা বেঁধে আছে। গোটা দেশে যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়ে আছে, সেগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষণ এবং সমাধান আজ জরুরি। সেটি একটি রাজনৈতিকভাবে দক্ষ সরকারের হাতে সম্পন্ন হতে পারে। তবে তার কাঠামো কী হবে, সেটি ভাবার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের।

● বদরুল আলম খান: লেখক ও গবেষক, ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন অধ্যাপক