খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন শোকের ক্যানভাস
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ফেসবুক পেজের প্রোফাইল পিকচার এখন কালো। এই শোক দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্য। তাঁর মতো অনেকেই তাঁদের প্রোফাইল পিকচার কালো করে শোক জানাচ্ছেন খালেদা জিয়ার জন্য; স্মরণ করছেন দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে তাঁর অবদান।
তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, ৪১ বছর ধরে বিএনপিকে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি গণতন্ত্রের লড়াই চালিয়ে যাওয়া খালেদা জিয়ার জীবনাবসান ঘটে মঙ্গলবার সকালে। তাঁর মৃত্যুতে দেশে দলমত–নির্বিশেষে সবাই এখন শোকাতুর। বিদেশি রাষ্ট্রনেতারাও জানাচ্ছেন শোক।
খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান সকালে মায়ের মৃত্যুর খবর জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিলে শোকাকুল হয়ে পড়ে বিএনপির অগুনতি নেতা, কর্মী, সমর্থক। তিনি লেখেন, ‘আমার মা, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, সর্বশক্তিমান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’ তাঁর সেই পোস্টে এরই মধ্যে তিন লাখের বেশি মন্তব্য জমা হয়েছে, যেখানে খালেদা জিয়ার জন্য শোক প্রকাশ করা হয়।
‘মহাকালের সমাপ্তি’ ঘোষণা করে বিএনপির মিডিয়া সেল তাদের ফেসবুক পেজে খালেদা জিয়ার মৃত্যুর কথা জানিয়ে পোস্ট দেওয়ার পর খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ১২ ঘণ্টায় ২১ হাজারের বেশি মন্তব্য জমা হয় সেই পোস্টের নিচে।
সেখানে জাহিদুল ইসলাম মিলন নামের একজন লেখেন, ‘বিএনপির আদর্শ, পথচলা কিংবা রাজনৈতিক অবস্থান অনেকের কাছে বিতর্কিত হতে পারে, তবে একটি বিষয়ে সবাই একমত হবেন, আর তিনি হলেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। এই মহীয়সী নারী শুধু একজন নেত্রী নন, তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অধ্যায়। যাঁর ধৈর্য ছিল পাহাড়সম, আত্মসংবরণ ছিল উদাহরণস্বরূপ। এক এক করে হারিয়েছেন জীবনের সব প্রিয়জন—স্বামী, সন্তান, সহযোদ্ধা। এক ছেলে শহীদ, আরেকজন নির্বাসিত। নিজে বন্দী, ঘরছাড়া, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার নির্মম শিকার। তবু কখনো মাথা নত করেননি।’
খালেদা জিয়া মানে স্বৈরাচারকে ‘না’—বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল পোস্ট দেওয়ার পর পাঁচ ঘণ্টায় সেখানে প্রায় দুই হাজার মন্তব্য জমা হয়। সেখানে তুহিন হাসান নামের একজন লেখেন, ‘যে জীবন সংগ্রামের, যে জীবন আপসহীন, সে জীবনের শেষ নাই।’
বিভিন্নজনই ফেসবুকে তাঁদের প্রোফাইল পিকচার কালো করেছেন খালেদা জিয়ার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায়। কেউ স্মরণ করছেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের নানা ঘটনা। কেউ আবার আবেগঘন ভাষায় তুলে ধরছেন ‘আপসহীন’ হিসেবে পরিচিত এই নেত্রীর ব্যক্তিগত দৃঢ়তা ও সংগ্রামের গল্প।
ফেসবুকে শায়েম ইউ রাকিব নামের একজন লেখেন, ‘এক দশকের বেশি সময় পর আবার পরিবারে মৃত্যুর সংবাদ এল। এবার তারেক রহমান (বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) হয়ে গেলেন সম্পূর্ণ অনাথ। হয়তো বাবাকে কিংবা ভাইকে হারানোর শোক তিনি মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা হলেও ভুলে থাকার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেই চোখ দুটিও এবার চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। মাকে হারানোর ব্যথা ও শূন্যতা কতটা গভীর, তা সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারে কেবল সেই সন্তানই, যে তার মাকে হারিয়েছে।’
আতিফ আবু বকর লিখেছেন, ‘বিদায় বিস্মিত বিস্ময়ের দৃঢ়তা, আমাদের সমকালের সুলতানা রাজিয়া। আপনি ছিলেন আমাদের এ মিছিলে, আমার প্রতিবাদী কবিতার শ্লোকে। ঘনঘোর ফ্যাসিবাদের মূলোৎপাটনের দীর্ঘ প্রতীক হয়ে দিল্লির আধিপত্যের মুখোমুখি শীর্ষ ব্যারিকেড।’
খালেদা জিয়ার ছবি পোস্ট করে সাদ মাকফুল নামের একজন তাঁর একটি উদ্ধৃতি জুড়ে দেন, ‘বিদেশে আমার কোনো ঠিকানা নেই। এটাই আমার ঠিকানা। এই দেশের মাটি ও মানুষই আমার সবকিছু। কাজেই আমি দেশের বাইরে যাব না।’
মোবাশ্বার হাসান নামের একজন তাঁর ফেসবুকে লেখেন, ‘আমি ১৯৯১ সালে তাঁকে সরাসরি দেখেছিলাম। তিনি ছিলেন সুন্দর, মার্জিত, বিনয়ী ও নরমভাষী। নির্বাচনী প্রচারের অংশ হিসেবে তিনি আমাদের উপশহরে এসেছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ঠিক তেমনই ছিলেন—সুন্দর, মার্জিত, বিনয়ী ও শান্ত স্বভাবের। আজ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ শোকে কাঁদছে। আপনি ছিলেন বাংলাদেশের সত্যিকারের এক রানি—সোনা বা পাথরের মুকুটে নয়, মানুষের ভালোবাসায় অভিষিক্ত এক রানি। শান্তিতে ঘুমান, বেগম খালেদা জিয়া।’
রুমি আহমেদ নামের একজন লেখেন, ‘১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর ঢাকার পুরবী হোটেলের সামনে একটি খোলা ছাদের জিপে চড়ে এক নক্ষত্র আমাদের ভূমিতে নেমে এসেছিল, তাঁর আলোয় আলোকিত করতে। আজ সেই আলো ফিরে গেছে আকাশে, অসীমতার মাঝে নিজের জায়গা খুঁজে নিতে।’
জহিরুল আলম সিদ্দিক নামের একজন লিখেছেন, ‘মানুষটা আপনার কেউ না, তবু তাঁর জন্য মন খারাপ হয়। সমালোচনা থেমে গেছে। শুধু এটুকুই মনে হচ্ছে—সংসদে তাঁকে আর কখনো দেখব না। তিনি যেমন ছিলেন, তেমন ছিলেন। কিন্তু তিনি নেত্রী ছিলেন, ১৬ কোটি মানুষের প্রধান ছিলেন।’
দেওয়ান মারুফ শুভ নামে একজন লেখেন, ‘আমি বিশ্বাস করতাম, বেগম খালেদা জিয়া হাসিনার পতন দেখার জন্যই বেঁচে আছেন। তাঁর মহাপ্রয়াণের শোকের মধ্যেও এই বিশ্বাস আমাকে একধরনের প্রশান্তি দেয়।’
সাদিকুর রহমান নামের একজন লিখেছেন, ‘বিদেশে না থেকে জেনেশুনেই কারাগারে ফিরে আসাই ছিল খালেদা জিয়ার সবচেয়ে বড় নৈতিক সিদ্ধান্ত। তিনি জানতেন, এটা জেল নয়—এটা কবর। তবু দেশের মানুষের সঙ্গে কষ্ট ভাগ করে নিতে তিনি ফিরে এসেছিলেন।’
জারিফ আজিজ নামের একজন লিখেছেন, ‘তিনি ছেড়ে যাননি। এই মাটিতেই শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন।’
এমন হাজারো মন্তব্যে ফেসবুক এখন হয়ে উঠেছে শোকের ক্যানভাস।